মঙ্গলবার তেল আবিব থেকে একটি শীতল ঘোষণা প্রতিধ্বনিত হয়। সমর্থকদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ইসরাইলি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ঘোষণা করেন: “যতক্ষণ না লক্ষ লক্ষ গাজাবাসী দেশ ছেড়ে চলে যায়, এবং যতক্ষণ না সিরিয়া বিভক্ত হয়, ততক্ষণ লড়াই শেষ হবে না।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধারণ ও ছড়িয়ে পড়া এই বক্তব্য সব অবশিষ্ট ভান সরিয়ে দেয়। ইসরাইলের যুদ্ধ আর ‘নিরাপত্তা’ বা ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী’ অভিযান নয়—এটি মানচিত্র পুনর্গঠনের, জাতিগুলিকে ছিন্নভিন্ন করার, জনগণকে বাস্তুচ্যুত করার ও ইতিহাস নতুনভাবে লেখার প্রয়াস।
এপ্রিলের শুরুতে, ইসরাইলি যুদ্ধবিমান আবারও সিরিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি বেসামরিক পল্লিগুলোর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করে।
কেন্দ্রীয় বিমানঘাঁটি থেকে শুরু হয়ে হামলাগুলো দক্ষিণ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে ইসরাইলি স্থলবাহিনী নাওয়া শহরের কাছে প্রবেশ করে একটি ছিদ্র সৃষ্টি করে এবং নয়জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে।
ইসরাইল সরকার এমন হামলার ব্যাখ্যায় বরাবরই ‘প্রতিরক্ষা’ বা ‘পূর্বপ্রস্তুতির’ কথা বলে। কিন্তু এর গভীরতর তাৎপর্য রয়েছে—এটি কেবল ভূগোল বা রাজনীতির বিষয় নয়, বরং স্মৃতির ওপর আঘাত।
নাওয়াকে লক্ষ্য করে, ইসরাইল কেবল একটি শহরকে নয়, বরং মুসলিম ঐতিহ্য ও জ্ঞানচর্চার এক অভয়ারণ্যকে আক্রমণ করেছে। এই শহরেই জন্মগ্রহণ করেন ইমাম আল-নওয়াবী—ইসলামী সভ্যতার এক মহান পণ্ডিত, যাঁর কাজ শতাব্দী পেরিয়ে মহাদেশজুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছে।
এই শহরেই তিনি কুরআন হিফজ করেন এবং জ্ঞানার্জনের প্রশান্তির জন্য ব্যবসার কোলাহল ত্যাগ করেন। কায়রো থেকে কুয়ালালামপুর পর্যন্ত বাড়ি, মাদরাসা ও মিম্বরে আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এই শহরে বোমা বর্ষণ মানেই জ্ঞানের উত্তরাধিকারীদের ওপর সরাসরি আঘাত।
নাওয়া থেকে খুব দূরে নয় তেল আল-জাবিয়া, যেখানে একদা খলিফা ওমর ইবনে আল-খাত্তাব দাঁড়িয়েছিলেন জেরুজালেমের চাবি গ্রহণের পূর্বে। মদিনা থেকে যাত্রা করে তিনি এখানেই তাঁর সেনাপতিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হস্তান্তরের ঠিক আগমুহূর্তে। তাঁদের পদচিহ্ন আজও হুরানের মাটিতে প্রতিধ্বনিত হয়। এটি পবিত্র ভূমি—শুধু বিশ্বাসের কারণে নয়, ইতিহাসের ওজনেও।
দক্ষিণ ও পূর্বে আরও বহু মনীষীর জন্মভূমি অবস্থিত। বিখ্যাত আইনজ্ঞ ও ধর্মতত্ত্ববিদ ইবনে আল-কাইয়িম আল-জাওজিয়্যাহ এসেছেন দারা শহরের ইজরা থেকে। আর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে কাথির—যিনি ‘আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া’ রচনায় খ্যাত—জন্মগ্রহণ করেন মাজদাল গ্রামে, বসরার নিকটে।
এই অঞ্চল, হুরান, বহুদিন ধরে জ্ঞানের উৎসস্থল হিসেবে পরিচিত। এর মাটি কেবল সীমানা নয়—এটি এমন এক সভ্যতাকে পুষ্ট করেছে, যা সম্প্রদায় ও সাম্রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃত।
এইখানেই, ইয়ারমুক নদীর তীরে, ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে খালিদ ইবনে আল-ওয়ালিদ মুসলিম বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী শাসন ভেঙে দিয়ে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেন।
প্রতিরোধ, বিজয় ও পুনরুজ্জীবনের ভূমি
এই ভূমিতে যুদ্ধ চালানো মানে কেবল সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা নয়; বরং এটি আরব ও ইসলামী ধারাবাহিকতার মূল সত্তাকে চ্যালেঞ্জ করা। হুরানের ভূমি নিষ্ক্রিয় নয়—এটি শতাব্দীর প্রতিরোধ, বিজয় ও পুনরুজ্জীবনের সাক্ষ্য বহন করে।
তাই, ইসরাইলের আক্রমণ কেবল শারীরিক নয়—এগুলো প্রতীকী। এগুলো কেবল সামরিক আধিপত্য নয়, বরং মুছে ফেলার রাজনীতি।
৮ ডিসেম্বর ২০২৪-এ আসাদ শাসনের পতনের পর থেকে ইসরাইল সিরিয়ার ভূখণ্ডে বছরের পর বছর ধরে সবচেয়ে তীব্র সামরিক অভিযান চালিয়েছে। শত শত বিমান হামলায় সামরিক অবকাঠামো, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অস্ত্র ভাণ্ডার ধ্বংস করা হয়েছে।
তাদের যুক্তি সরল: তারা নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু হামলার ব্যাপকতা ও সময়সীমা দেখিয়ে দেয়, যে বিষয়টি এর চেয়েও গভীর।
আসাদ মস্কোতে পালিয়ে যাওয়ার একদিন পরই ইসরাইলি নেতারা ঘোষণা দেন, তারা সিরিয়ার ভিতরে একটি ‘জীবাণুমুক্ত নিরাপত্তা অঞ্চল’ গঠনের পরিকল্পনা করেছে—যার পরিমাণ প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার, যা গাজা উপত্যকার সমান।
আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন সত্ত্বেও, ইসরাইলি বাহিনী বর্তমানে হারমন পর্বতের সিরীয় অংশে অবস্থান করছে। প্রাথমিকভাবে এ অবস্থানকে ‘ক্ষণস্থায়ী’ বলা হলেও, এখন তারা সে ভানও করছে না।
কোনো সময়সীমা নেই। কোনো প্রস্থান পরিকল্পনা নেই।
“আমরা থাকব,”—পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ। “আমরা নিশ্চিত করব যে গোটা দক্ষিণাঞ্চল সামরিকীকরণ করা হয়েছে এবং আমরা ড্রুজ সম্প্রদায়ের জন্য কোনো হুমকি সহ্য করব না।”
এইভাবেই শুরু হয় অভিনয়—সংখ্যালঘু সুরক্ষার নামে। ইসরাইল দাবি করে, তারা নতুন সিরিয়ান নেতৃত্ব সৃষ্ট কাল্পনিক হুমকি থেকে ড্রুজদের রক্ষা করছে। কিন্তু ইতিহাস এই ধরনের দাবির মিথ্যাকে বারবার উন্মোচন করেছে।
ফাঁপা দাবি
ফিলিস্তিনের ড্রুজ সম্প্রদায়, যারা বহু বছর ধরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হয়ে রক্ত দিয়েছে, তারা ভেবেছিল—এই অবদানের বিনিময়ে রাষ্ট্র থেকে ন্যায্যতা পাবে। এরা গ্যালিলির ড্রুজ—আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলি নাগরিক—যারা রাষ্ট্রের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, অথচ বাস্তবে নিজেদের মাটিতেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়েছে।
এই বিশ্বাসঘাতকতা ছিল কাঠামোগত। আবাসন, শিক্ষা, জমির মালিকানা ও রাজনৈতিক স্বীকৃতির প্রতিটি স্তরেই তারা বৈষম্যের শিকার। ইসরায়েলের শীর্ষ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক *ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ* (INSS) ২০২৪ সালে সতর্ক করে বলেছিল: “যদি ইসরায়েল ড্রুজ সম্প্রদায়ের বৈধ উদ্বেগ উপেক্ষা করে, তবে এই জনগোষ্ঠী পরিত্যক্ত ও বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারে—যা তাদের রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে বিপন্ন করতে পারে।”
২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতি-রাষ্ট্র আইন—যেটি ইসরায়েলকে একটি একক ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং অ-ইহুদিদের স্থায়ীভাবে নিচু অবস্থানে ঠেলে দেয়—ড্রুজদের জন্য ছিল এক গভীর হতাশার কারণ। “রক্তের চুক্তি” যা একদিন ছিল গর্বের প্রতীক, এখন তা তিক্ত স্মৃতিতে রূপ নিয়েছে।
আজ, ড্রুজদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। অথচ, সেই ইসরায়েলই সিরিয়ায় নিজেদেরকে তাদের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করছে—যে রাষ্ট্র নিজের ভেতরেই তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ।
বেদুইনদের গল্পও একই। বহু বেদুইন, যারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে কাজ করেন এবং তথাকথিত ‘অবৈধ’ গ্রামে বসবাস করেন, বারবার উচ্ছেদ ও গৃহচ্যুতির শিকার হচ্ছেন।
এটি নিরাপত্তা নয়। এটি শোষণ—ছদ্ম উদ্বেগের মুখোশে মোড়া।
নীতির আড়ালে ইসরায়েলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা
ইসরায়েলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন আর কেবল সীমানা কিংবা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিয়ে নয়। সিরিয়ার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন—একটি স্থায়ীভাবে বিভক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্ন।
আসাদের পলায়নের পরদিনই ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা‘আর ঘোষণা দেন: “সিরিয়া আর একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না।” তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য স্বায়ত্তশাসিত ক্যান্টনের আহ্বান জানান। তাঁর ভাষ্য ছিল, “একক, সার্বভৌম সিরিয়ার ধারণা অবাস্তব।”
এর চেয়েও স্পষ্ট বক্তব্য আসে ইসরায়েলি সামরিক ভাষ্যকার রামি সিমানির কাছ থেকে। তিনি বলেন: “সিরিয়া একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র, যার প্রকৃত অস্তিত্বের অধিকার কখনও ছিল না। এটি একটি আরব রাষ্ট্র নয়, এবং কোনো জাতির রাষ্ট্র তো নয়ই… এরদোগান একটি ঐক্যবদ্ধ সিরিয়াকে সমর্থন করেন। কিন্তু ইসরায়েলের স্বার্থ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসরায়েল সিরিয়াকে অদৃশ্য করতে পারে এবং করবে। তার জায়গায় থাকবে পাঁচটি ক্যান্টন… এবং ইসরায়েলকে তার দখল আরও গভীর করতে হবে।”
এটি কেবল চটকদার বক্তব্য নয়। এটি এখন কার্যকর নীতি।
ছিন্নভিন্নতার রূপরেখা
ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ কল্পনায় রয়েছে একটি খণ্ডিত, ছিন্নভিন্ন সিরিয়া—উত্তরে কুর্দি ক্যান্টন, দক্ষিণে ড্রুজ এলাকা, উপকূলজুড়ে আলাউইট অঞ্চল, আর মাঝখানে ছড়িয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন সুন্নি জনপদ।
লক্ষ্য শান্তি নয়—লক্ষ্য পক্ষাঘাত।
একটি ভাঙা ও বিভক্ত সিরিয়া কখনোই নিজের জমি রক্ষা করতে পারবে না। পারবে না ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলতে। স্বাধীনতা, পুনর্গঠন এমনকি স্বপ্ন দেখাও তাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
এই তথাকথিত “নিরাপত্তা”-র নামে ইসরায়েল শুধু আগ্রাসনই নয়, এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক খেলা খেলছে—যার নজর এখন সিরিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে তুরস্ক পর্যন্ত পৌঁছেছে।
আঙ্কারা যতই শান্তির বার্তা পাঠাক, ইসরায়েলি কৌশলবিদদের দৃষ্টিতে এখন তুরস্কই সবচেয়ে বড় হুমকি—ইরানের চেয়েও। কারণ, তুরস্ক একটি ঐক্যবদ্ধ সিরিয়ার পক্ষে। আর ইসরায়েল তার বিলুপ্তির পক্ষে।
এপ্রিলের শুরুতে নাওয়ার কাছাকাছি ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত বোমা হামলাগুলো শুধু দামেস্কের উদ্দেশেই বার্তা ছিল না—সেগুলো আঙ্কারাকেও জানিয়ে দিচ্ছিল: “এই অঞ্চল আমাদের প্রভাব বলয়।”
নীরব প্রতিরোধ
দামেস্ক সেই বার্তার জবাবে নিরুত্তর থেকেছে। নতুন নেতৃত্ব, যা এখনো স্থির নয়, শুধু একটি সতর্ক বিবৃতি দিয়েছে। কেউ কেউ সম্ভাব্য শান্তির কথাও বলেছে। নতুন রাষ্ট্রপতি আহমেদ আল-শারা বলেছেন, “আমরা ১৯৭৪ সালের চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সিরিয়ার ভূমি কোনও বহিরাগত আগ্রাসনের ঘাঁটি হতে দেবে না।”
এক পর্যায়ে, শারা এক মার্কিন আইনপ্রণেতার সঙ্গে আলোচনায় জানান, সিরিয়া “সঠিক পরিস্থিতিতে” ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দিতেও প্রস্তুত—যদি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও দক্ষিণ-পশ্চিম সিরিয়ার দখল প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য সমাধান আসে। তবে পরে তিনি স্পষ্ট করেন, দখল চলতে থাকলে সম্পর্ক স্বাভাবিকের প্রশ্নই ওঠে না।
তবুও, এই সম্ভাব্য খোলা দরজার জবাব আসে বোমার আঘাতে—আর এমন ঘোষণায়, যেখানে আপোষের ভানটুকুও নেই।
ইসরায়েলি সামরিক ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS) বা নতুন সিরিয়ান সেনাবাহিনীকে “দামেস্কের দক্ষিণে” প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
তিনি কুনেইত্রা, দারা এবং সুইদা প্রদেশ সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের দাবি করেন এবং বলেন, “ড্রুজ সম্প্রদায়ের জন্য কোনো হুমকি সহ্য করা হবে না।”
ইসরায়েলের বার্তা স্পষ্ট: সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের আর কোনো জায়গা নেই।
অসম্ভব দাবির তালিকা
ওয়াশিংটনে ইসরায়েল আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার জন্য তদবির করছে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার সামনে যে শর্তপত্র রেখেছে, তা প্রায় অসম্ভব—যেমন, সিরিয়ার ভেতরে ফিলিস্তিনিদের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করতে হবে।
একটি দেশ, যা গত ১৪ বছর ধরে যুদ্ধের ভার বইছে, তাকে বলা হচ্ছে কেবল তার স্বাধীনতাই নয়, বরং তার অতীত, তার মিত্রতা, এমনকি তার কণ্ঠস্বরও ত্যাগ করতে হবে।
জবাব আসছে নাওয়া থেকে
তবুও, সব জায়গায় নীরবতা নেই।
নাওয়ায় নিহত নয়জন বেসামরিক মানুষের জানাজা এক বিশাল প্রতিবাদে রূপ নেয়। দেশজুড়ে রাস্তায় নামে অসংখ্য সিরীয়। ক্ষোভ, বেদনা, আর সংকল্প একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়।
এটাই হুরানের প্রতিরোধ—যা ইতিহাসের মতোই প্রাচীন, আর স্মৃতির মতোই গভীর।
নাওয়ার সেই নয়জনের শেষযাত্রা এক বিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল। শহর থেকে শহরে, মানুষ তাদের শ্রদ্ধা জানাতে নয়—প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছিল।
যুদ্ধের ক্লান্তি যেন এবার নতুন একটি সংকল্পের জন্ম দিচ্ছে। যে প্রজন্ম এক সময় আশা হারিয়েছিল, তারা আবার আশার আলো খুঁজছে—সরকারে নয়, নিজেদের ভেতরে, নিজেদের দেশেই।
কারণ, সিরিয়া কেবল একটি রাষ্ট্র নয়—এটি এক মহাসভ্যতা। সাম্রাজ্যের জন্মভূমি, আর আক্রমণকারীদের কবরস্থান। এটি ক্রুসেড টিকিয়ে রেখেছে, উপনিবেশ প্রতিহত করেছে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারবার জেগে উঠেছে।
ক্ষত তার অনেক, কিন্তু চেতনা অটুট। শত্রু শক্তিশালী হতে পারে, কিন্তু এই ভূমি মনে রাখে।
ইসরায়েলের কৌশল—তার জটিল হিসাব—একটি মারাত্মক ভুলে দাঁড়িয়ে: একটি জাতিকে মানচিত্র কেটে বা বোমায় ছিন্নভিন্ন করা যায় না। কারণ সিরিয়া কেবল এক ভূখণ্ড নয়—এটি নাওয়া আর ইয়ারমুক, ইবনে কাথির আর সালাহউদ্দিন, সুলতান পাশা আল-আতরাশ আর খালিদ ইবনে আল-ওয়ালিদ।
এটি ইতিহাসের রক্তমাংসে গাঁথা মর্যাদা—মাটিতে খোদাই করা আত্মপরিচয়। সিরিয়া অদৃশ্য হবে না। চুপচাপ বিলীনও হবে না। আর তার জনগণ, যত নির্যাতিতই হোক, আবার জেগে উঠছে।
দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরাইল যা দেখাচ্ছে তা আত্মসমর্পণ নয়—এটা স্মরণ। স্মৃতির পুনর্জাগরণ।
সিরীয় ও ফিলিস্তিনিদের এই সংগ্রাম একে অপরেরই প্রতিবিম্ব। ক্ষতও অভিন্ন।
আর ইতিহাস—যে ইতিহাস সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছে—আজও তাদের পক্ষেই দাঁড়িয়ে।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই