সিরিয়ার জনগণ যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে অপসারণে সফল হয়, তখন অঞ্চলটির ভূ-রাজনৈতিক চিত্রে বড় পরিবর্তন আসে।
আসাদের পতনের পর ইসরাইল নতুন সিরীয় সরকার ও তার মিত্রদের—বিশেষ করে তুরস্ককে—লক্ষ্য করে আগ্রাসন শুরু করে। দেশব্যাপী শত শত সামরিক স্থাপনা ও সরঞ্জামে হামলা চালিয়ে ইসরাইল নতুন সরকারকে দেশের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করতে ও স্থিতিশীলতা অর্জনে বাধা দিতে চায়।
বিমান হামলার পাশাপাশি ইসরাইল ড্রুজ, কুর্দি ও আলাউইত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন উসকে দেয়ার চেষ্টা করেছে, যা অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতকে উৎসাহিত করে।
আসাদকে সিরিয়ায় হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে রাশিয়া
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রে তদবির করেছেন সিরিয়ায় মার্কিন উপস্থিতি বজায় রাখা, ওয়াইপিজি কুর্দি মিলিশিয়াকে সমর্থন অব্যাহত রাখা এবং আঙ্কারার প্রভাব ঠেকাতে রাশিয়াকে আবার সামরিক ঘাঁটিতে ফিরিয়ে আনার জন্য।
তবে ওয়াশিংটনে সাম্প্রতিক সফরে নেতানিয়াহু ট্রাম্পের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন পাননি।
গত মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টাকারীদের কঠোরভাবে সতর্ক করেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর তিনি বলেন, ‘যারা সিরিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করবে, তারা সিরিয়ার সরকার ও তুরস্ক উভয়ের প্রতিরোধের মুখে পড়বে।’
এই বক্তব্যে তুরস্কের স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার অঙ্গীকার ফুটে ওঠে।
এরদোগানের হুঁশিয়ারির পরও ইসরাইল হামলা অব্যাহত রাখে। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে ইসরাইলি বিমান হামলা সিরিয়ার নেতৃত্বের প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখা হয়। নেতানিয়াহু ও ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এটি সিরিয়ার শাসনের প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা। আমরা দক্ষিণ দামেস্কে বাহিনী মোতায়েন বা ড্রুজদের প্রতি হুমকি মেনে নেব না।’
সিরিয়াকে নিয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রকাশ ইসরাইলের
সিরিয়াকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা ইসরাইলের
সিরিয়ায় যেভাবে ইসরাইলকে টেনে আনল ড্রুজ সম্প্রদায়
‘বেপরোয়া পদক্ষেপ’
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট এই হামলাকে ‘নিন্দনীয় ও বেপরোয়া’ উল্লেখ করে বলেন, এটি নিরাপত্তা সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তিনি আরব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সিরিয়ার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান এবং বলেন, সিরিয়া তার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আপস করবে না এবং সব উপায়ে জনগণের অধিকার রক্ষা করবে।
ইসরাইল ঐতিহ্যগতভাবে সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করে, বিচ্ছিন্নতাবাদে উসকানি দেয় এবং অভ্যন্তরীণ সহিংসতাকে উত্সাহিত করে, যাতে সুবিধাজনক পরিবেশে কাজ করা যায়।
সিরিয়ায় ইসরাইলের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ তুরস্ককে আঞ্চলিক আলোচনার কেন্দ্রে এনেছে, বিশেষ করে আজারবাইজান ইস্যুতে আঙ্কারা-তেল আবিব আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর। এটি দেখায়, ইসরাইলি হস্তক্ষেপ চলতে থাকলে সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না।
তুরস্ক যদি কেবল সতর্কবার্তা দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকে এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি না নেয়, তবে তার আঞ্চলিক বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পেতে পারে। ইসরাইল অস্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখলে এর প্রতিক্রিয়া তুরস্ককেও বহন করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। তুরস্কের উচিত গাজা, পশ্চিমতীর, লেবাননসহ ইসরাইলের অন্যান্য হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ তুলে ধরার মাধ্যমে বৈশ্বিক মঞ্চে বিষয়টি উত্থাপন করা। এতে ইসরাইলি আগ্রাসনের বৃহত্তর প্রভাব তুলে ধরা সম্ভব হবে।
সিরিয়াকে সমর্থন দিয়ে আঙ্কারার নেতৃত্বে গঠিত আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর কাজ দ্রুততর করা উচিত, যাতে সহিংসতা জর্ডান, লেবানন, ইরাকসহ অন্যান্য দেশে না ছড়িয়ে পড়ে। এই দেশগুলো ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে, আর ইসরাইলের নীতির কারণে জনগণের ক্ষোভ বাড়ছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তুরস্কের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কার্যকর করা, আর ইসরাইলপন্থী ও তুরস্কবিরোধী গোষ্ঠী বাধা দিলে বিকল্প কৌশলের প্রস্তুতি রাখা।
সিরিয়ার উত্তরণ কোন পথে
কেন সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ করা কঠিন
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের উত্থানে নেপথ্যের কী বার্তা দিচ্ছে
সিরিয়ার প্রতিবিপ্লব যেভাবে ব্যর্থ করা হয়
সিরিয়ার নতুন সরকার কি দেশকে পুনর্গঠন করতে পারবে
সিরিয়া কি তবে ইসরাইলে আক্রমণ করে বসবে
পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা
এরদোগানের উচিত ট্রাম্পের কাছে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা স্পষ্ট করা। প্রথমত, ইসরাইল যদি অস্থিতিশীলতা চালিয়ে যায়, তবে অন্য আঞ্চলিক শক্তিগুলো—যেমন তেহরান—সুযোগ নিতে পারে এবং তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে সহিংসতা প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের উসকানি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে দুটি কঠিন বিকল্পে ফেলে: হয় প্রতিশোধ নিয়ে যুদ্ধ শুরু করা, নয়তো চুপ থেকে দুর্বল ও অযোগ্য হিসেবে দেখা দেয়া। উভয় পরিস্থিতিই মৌলবাদ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করে।
তৃতীয়ত, সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের উপর ইসরাইলের অস্ত্র ব্যবহারের ফলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। কয়েক দশক ধরে, এই অঞ্চলের সুন্নিরা পশ্চিমা সমর্থিত স্বৈরশাসক ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার নীতিতে হতাশ হয়েছে। যদি ইসরাইল সিরিয়ার ঐক্য ও স্থিতিশীলতার নতুন আশাকে ক্ষুণ্ন করে, তবে তার প্রতিক্রিয়া অঞ্চলের অন্যান্য মিত্র শাসনব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
চতুর্থত, ইসরাইলের ক্রমাগত উস্কানি শেষ পর্যন্ত অন্যান্য দেশকে সিরিয়ার সাহায্যে টেনে আনবে, যার ফলে প্রতিযোগিতামূলক এজেন্ডাগুলির মাধ্যমে সম্পদ নিঃশেষ হবে, যেমনটি গত ১৫ বছরের সংঘাতে হয়েছে। অর্থ, সময় ও জীবন নষ্ট হবে, আর সিরিয়া স্থিতিশীলতার ক্ষীণ সুযোগ হারাবে—অন্যরা সম্ভবত এটি অনুসরণ করবে।
অবশেষে, ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলির সাথে নিজেকে ঘিরে রাখার ইসরাইলের কৌশল সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপরীতমুখী ফল দিবে। আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্র চরমপন্থা ও অভিবাসন সংকটের প্রজননক্ষেত্র হয়ে ওঠে। যদি সিরিয়া একই পথ অনুসরণ করে, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সমর্থন করার জন্য এই অঞ্চলে ফিরে আসবে, এমন এক পরিবেশে যেখানে এটি প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা হবে।
এই সবকিছু বিবেচনায়, তুরস্কের উচিত মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলির সাথে সহযোগিতা করা, যাদের ইসরাইলের অস্থিতিশীল নীতি থেকে মুক্ত একটি নিরাপদ অঞ্চলে স্বার্থ রয়েছে। এই সহযোগিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে রাজি করানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যাতে নতুন সিরিয়ান নেতৃত্ব সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে।
যদি শারাকে তার ভূমিকা পালনের ক্ষমতা না দেওয়া হয়, তাহলে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পদক্ষেপগুলোর ব্যর্থতা নিশ্চিত। এই ব্যর্থতা সিরিয়ার পুনর্গঠন পথকে দুর্বল করে দেবে এবং যেসব দেশ সিরিয়ার উপর নির্ভর করবে, তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই
সিরিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতি, কেন ভয় পাচ্ছে ইসরাইল
আসাদ-পরবর্তী সিরিয়া নিয়ে যে কারণে সঙ্ঘাতে জড়াতে পারে তুরস্ক-ইসরাইল
‘সঠিক পরিস্থিতিতে’ সিরিয়া-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে প্রস্তুত আল-শারা