ইসরাইল সম্প্রতি গাজা, পশ্চিম তীর, লেবানন এবং সিরিয়ায় একযোগে সামরিক হামলা চালানোর পাশাপাশি সিরিয়ার ড্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষার নাম করে বিশেষ বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরাইল দাবি করছে, তারা চরমপন্থীদের হাত থেকে ড্রুজদের রক্ষা করছে, যদিও বাস্তবে এটি বহু পুরনো একটি সাম্প্রদায়িক প্রকল্পেরই সম্প্রসারণ।
আল-কায়েদার সাবেক শাখা HTS-এর উত্থান এবং সিরিয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তী শাসকগোষ্ঠীর ইসলামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি আলাউই ও ড্রুজ সংখ্যালঘুদের আরও অনিশ্চয়তায় ফেলেছে। ইসরাইল এই সুযোগে ১৯২০ সাল থেকে চালু থাকা একটি কৌশলকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, যার লক্ষ্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করে “সংখ্যালঘু সুরক্ষা”র নামে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
এই পরিকল্পনার ভিত্তিতে ইসরাইল পূর্বে লেবাননে ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের সঙ্গে জোট গঠন করেছিল এবং ফালাঙ্গিস্টদের মতো ফ্যাসিস্ট খ্রিস্টান গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন দিয়েছিল। ফিলিস্তিনের ড্রুজদের পৃথক করে মিত্রে পরিণত করার চেষ্টা ১৯২০-এর দশকে শুরু হয়। ইহুদিবাদীরা তৎকালীন মুসলিম-খ্রিস্টান ঐক্যের বিপরীতে এই ছোট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে টার্গেট করে।
ব্রিটিশ ও ইহুদিবাদীরা ড্রুজদের নিয়ে নানান উপনিবেশিক পৌরাণিক কাহিনী ছড়ায়—যেমন তাদের ইউরোপীয় বা ক্রুসেডার বংশোদ্ভূত হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। ইহুদিবাদীরা ড্রুজ সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ দলাদলি (তারিফ বনাম খায়ের পরিবার) ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক পরিচয় জোরদার করে, এবং ব্রিটিশরা একটি পৃথক সাম্প্রদায়িক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে।
এসব প্রচেষ্টার ফলে ১৯৩২ সালে সাম্প্রদায়িক ড্রুজ ইউনিয়ন সোসাইটি গঠিত হয়, যার মাধ্যমে ড্রুজদের ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলন থেকে পৃথক করা হয়।
১৯৩২ সালে সাম্প্রদায়িক ড্রুজ ইউনিয়ন গঠনের পর ১৯৩৩ সালে ইহুদিবাদীরা একটি নির্দিষ্ট উপদলের সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে ড্রুজ নেতাদের সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা তীব্রতর করে। এর ফলে বিভিন্ন ড্রুজ উপদলের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়, তবে জাতীয়তাবাদী তারিফ পরিবার নেতৃত্ব ধরে রাখে এবং ইহুদি-সহযোগী উপদলকে পরাজিত করে। ইহুদিবাদীরা আশা করেছিল, ফিলিস্তিনের ড্রুজদের জোটে টানতে পারলে সিরিয়া ও লেবাননের বৃহত্তর ড্রুজ জনগোষ্ঠীর দিকেও পথ খুলে যাবে।
১৯৩৬-৩৯ সালের মহান ফিলিস্তিনি বিদ্রোহে ড্রুজদের অংশগ্রহণ ঠেকাতে ইহুদিবাদী ও ব্রিটিশরা ড্রুজদের লক্ষ্য করে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালায়। তারা ইসফিয়ার ড্রুজ নেতা শায়খ হাসান আবু রুকুনকে ব্যবহার করে বিদ্রোহ থেকে বিরত রাখতে চায়, যদিও ১৯৩৮ সালে তাকে বিদ্রোহীরা সহযোগী হিসেবে হত্যা করে। জায়নিস্টরা এরপর আবু রুকুনের হত্যাকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হিসেবে প্রচার করে, যদিও বিদ্রোহীরা প্রায় ১,০০০ ফিলিস্তিনি সহযোগীকেও হত্যা করেছিল, যাদের অধিকাংশই সুন্নি মুসলিম।
১৯৩৭ সালের শেষদিকে ব্রিটিশ পিল কমিশনের ইহুদি রাষ্ট্র প্রস্তাবে ড্রুজদের সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়, যদিও একই সময় ইহুদিবাদীরা সিরিয়ান নেতা সুলতান আল-আত্রাশকে ড্রুজদের “স্বেচ্ছা” স্থানান্তরের প্রস্তাব দেয়। আল-আত্রাশ সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, যদিও আশ্রয়প্রার্থীদের স্বেচ্ছা অভিবাসনে তিনি সম্মত হন। এ কাজে ইহুদিবাদীরা তার প্রাক্তন সহযোগী ইউসুফ আল-‘আয়সামিকে ব্যবহার করে। চেইম ওয়েইজম্যান ১০,০০০ ড্রুজকে সরিয়ে গ্যালিলিতে ইহুদি উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে ট্রান্সজর্ডানে ড্রুজদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেয়া হয়, যা ১৯৪৫ সালে ব্যর্থ হয়। তবে ১৯৪৬ সালে স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে ড্রুজদের জমি কেনা সম্ভব হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে কিছু ড্রুজ প্রতিরোধে যোগ দিলেও ইহুদিবাদীরা তাদের নিরপেক্ষ বা সহযোগী রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
১৯৪৮ সালে সিরিয়া ও লেবাননের ড্রুজরা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধে অংশ নেয় এবং রামাত ইয়োহানান উপনিবেশে আক্রমণ চালায়। যদিও ইহুদি বিজয়ের পরে হতাশ ড্রুজ যোদ্ধাদের ইহুদি গোয়েন্দা ও স্থানীয় সহযোগীরা নিজেদের পক্ষে টেনে নেয়।
১৯৪৮ সালে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী-উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পরই ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে বিভাজন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ইসরাইল ফিলিস্তিনি ড্রুজদের অন্যান্য মুসলমানদের থেকে “স্বতন্ত্র” ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের জন্য পৃথক ধর্মীয় আদালত প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ড্রুজদের জাতিগত পরিচয় “আরব” না বলে “ড্রুজ” হিসেবে তুলে ধরা শুরু হয়। যদিও বাস্তবে তারা অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের মতোই জমি দখল ও জাতিগত নিপীড়নের শিকার হতে থাকে। এসময় ড্রুজ সহযোগীরা ইসরাইলি সমর্থনে সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব দখল করে এবং সেনাবাহিনীতে ড্রুজদের তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব দেয়, যা ইসরাইল গ্রহণ করলেও সংবেদনশীল ইউনিটে তাদের রাখা হয়নি।
এই পরিস্থিতির মধ্যেও ড্রুজ সমাজে ইসরাইলি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বজায় থাকে। ফিলিস্তিনি ড্রুজ কবি সামিহ আল-কাসিম ছিলেন প্রতিরোধের অন্যতম মুখ, যিনি মাহমুদ দারবিশ ও তৌফিক জাইয়াদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি কবিতার প্রধান কণ্ঠস্বরে পরিণত হন। তাঁর কবিতা ফিলিস্তিনের ভেতরে ও বাইরে আবৃত্তি হয় এবং অনেক কবিতা সুরারোপিত হয়েছে। প্রতিরোধের অন্য ড্রুজ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন ঔপন্যাসিক সালমান নাটুর, কবি সামি মুহান্না, পণ্ডিত সুলায়মান বশির এবং ইতিহাসবিদ কাইস ফিরো। তারা সবাই সাহিত্য, ইতিহাস ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বর্তমানে ইসরাইল সিরিয়ার ড্রুজ নেতৃত্বকে সহ-অপ্ট করার চেষ্টা করছে, যেমন তারা পূর্বে ফিলিস্তিনি ড্রুজ সহযোগীদের কাজে লাগিয়ে করেছিল। কিন্তু সিরিয়ার ড্রুজ নেতারা এ প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করছেন এবং নিজেদের সিরিয়ার জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা দিচ্ছেন, যদিও তারা ইসলামপন্থী ও সাম্প্রদায়িক শাসনের বিরোধিতাও করছেন। তবে আরব ঐক্য ধ্বংসে ইসরাইলের প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই




