টুডেনিউজ বিডি ডটনেট
সিরিয়ায় একে অপরের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়াতে একটি ‘সংঘাত নিরসন রেখা’ স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক ও ইসরাইল। মিডল ইস্ট আইকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুজন পশ্চিমা কর্মকর্তা। তাদের ভাষ্য, ভুল বোঝাবুঝি থেকে উদ্ভূত অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ রোধ করতেই দুই দেশ এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহেই ইসরাইলি বিমান বাহিনী সিরিয়ায় একাধিক হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল হামা ও তিয়াস বিমান ঘাঁটি—পরবর্তীটি ‘টি৪’ নামেও পরিচিত। এই ঘাঁটিতে শিগগিরই তুরস্কের সামরিক মোতায়েনের পরিকল্পনা ছিল। ঘাঁটিটি পরিদর্শন ও পুনর্গঠনের জন্য যখন আঙ্কারা একটি প্রযুক্তিগত দল পাঠাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই ইসরাইল ওই হামলা চালায়।
পশ্চিমা কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তুরস্কের প্রতিপক্ষদের জানিয়ে দিয়েছেন- তুর্কি সেনা বা সম্পদ টি৪-তে মোতায়েনের পূর্বে ইসরাইলের কাছে সেখানে বিমান হামলা চালানোর জন্য সীমিত সময় রয়েছে। নেতানিয়াহুর মতে, একবার তুরস্ক ঘাঁটিতে প্রবেশ করলে, সেটি ইসরাইলের জন্য ‘অভিযানের বাইরে’ গণ্য হবে।
ইসরাইলি বাহিনীর হামলার শিকার -তা যদি ভুলবশতও হয়- তুর্কি সেনারা হলে, তা এক ভয়াবহ সংঘাতের দিকে গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে, ঘাঁটিতে তুর্কি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বসানো হলে ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলোর চলাচলেও গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে।
মিডল ইস্ট আই তাদের একটি পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আঙ্কারা টি৪ ঘাঁটি দখলের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু করেছে, যার উদ্দেশ্য সেখানে নজরদারি ও আক্রমণ-ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোন মোতায়েন করা। তুরস্ক ‘হিসার’ নামক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বসানোর পরিকল্পনাও নিয়েছে। স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘ পাল্লার হুমকি প্রতিহত করতে ঘাঁটির অভ্যন্তর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি স্তরবদ্ধ প্রতিরক্ষা বলয় গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে তুর্কি সেনাবাহিনী। ঘাঁটিটির পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত রুশ-নির্মিত এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অস্থায়ীভাবে মোতায়েনের কথাও বিবেচনায় রয়েছে।
একই সূত্র জানায়, ইসরাইলি বিমান হামলার পর নেতানিয়াহু আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে তুরস্কের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর পথে অগ্রগতি হয়েছে। আলোচনা এখনো চলছে। নেতানিয়াহুর বক্তব্য অনুযায়ী, দক্ষিণ সিরিয়াকে পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণে ইসরাইল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যেখানে তুর্কি সামরিক উপস্থিতিও অন্তর্ভুক্ত।
তুরস্ক-ইসরাইল সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণকারী এক পৃথক সূত্র নিশ্চিত করেছে- টি৪ ঘাঁটিতে ইসরাইলি হামলার পর থেকে উভয় দেশ একটি সংঘাত নিরসন রেখা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্রটি জানায়, “তুর্কি ও ইসরাইলি উভয় কর্মকর্তাই একই দিনে এক ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন—তারা সিরিয়ায় একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চান না। বিষয়টি নিঃসন্দেহে সমন্বিত প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।”
ফিদান : তুরস্ক কোনো সংঘাতে আগ্রহী নয়
তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান শুক্রবার রয়টার্সকে জানান, তুরস্ক সিরিয়ায় ইসরাইলের সঙ্গে কোনোপ্রকার সংঘাতে যেতে চায় না। একই দিনে রয়টার্স একটি শীর্ষস্থানীয় ইসরাইলি কর্মকর্তার কাছ থেকেও একই বক্তব্য প্রকাশ করে- একেবারে অভিন্ন ভাষায়।
পশ্চিমা সূত্রের ভাষ্য, ইসরাইল প্রকাশ্যে কড়া ভাষায় হুমকি দিলেও বাস্তবে তারা হামা ও পালমিরায় তুর্কি সামরিক উপস্থিতিকে মেনে নেয়ার সম্ভাবনা রেখেই সংঘাত নিরসনের কাঠামো বিবেচনা করছে।
গত ডিসেম্বর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর অঞ্চলটিতে তুরস্কের প্রভাবশালী অবস্থান ইসরাইলের জন্য নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। তুরস্ককে এখন ইরানের চেয়েও বড় সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে তেল আবিব। সেই থেকেই আঙ্কারা ও দামেস্ক একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। প্রস্তাবিত ওই চুক্তির আওতায়, কার্যকর সামরিক শক্তিবিহীন সিরিয়ার নতুন সরকারকে বিমান কভার ও সামরিক নিরাপত্তা প্রদানে সহায়তা করবে তুরস্ক।
তুরস্কের অন্যতম কৌশলগত লক্ষ্য হলো, সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান আরও জোরদার করা। যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ার প্রাক্কালে বিষয়টি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, “সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখনো চূড়ান্ত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সক্রিয়। ওয়াশিংটনের লক্ষ্য হলো—তুরস্ক ও ইসরাইল যেন উত্তেজনা কমিয়ে আনতে সম্মত হয়।”
তুর্কি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পূর্ব সিরিয়ায় আইএস বিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে যাচ্ছে আঙ্কারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের প্রস্তুতির মাঝেই তুরস্ক একটি আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের চেষ্টা করছে, যার অন্তর্ভুক্ত হবে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাক। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আইএস-বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
টি৪ ও পালমিরা ঘাঁটিকে এ উদ্দেশ্যে অত্যন্ত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে—এ অঞ্চলে আইএসের অবশিষ্ট ঘাঁটি খুঁজে বের করে নির্মূল করতে এই দুটি ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক বলে মনে করছে আঙ্কারা।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও, মিডল ইস্ট আই ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানিয়ে রেখেছে।
তবে সিরিয়া সংক্রান্ত ইসরাইলের প্রধান উদ্বেগ এখনো একই—দেশটির আকাশসীমায় ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলোর অবাধ অভিযান পরিচালনার স্বাধীনতা। যদি তুর্কি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকরভাবে মোতায়েন করা হয়, তাহলে সিরিয়ার আকাশসীমায় ইসরাইলি অভিযানে তা বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
শুক্রবার হাকান ফিদান বলেন, “আমরা সিরিয়ার পক্ষে কথা বলি না। সিরিয়ার নিরাপত্তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র সিরীয় জনগণের। যদি তারা ইসরাইলের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে চায়, সেটি সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজস্ব বিষয়।”
সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর




