সিরিয়ার প্রতিবিপ্লব যেভাবে ব্যর্থ করা হয়

টুডেনিউজ বিডি ডটনেট

গত ৮ মার্চ সিরিয়ায় সংঘটিত ঘটনাগুলোর সরকারিভাবে প্রকাশিত কোনো বিস্তারিত বিবরণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সিরিয়ার উপকূলে সংগঠিত সেসব ঘটনাবলী মূলত একটি ‘অভ্যুত্থানের চেষ্টা’ ছিল।

লাতাকিয়া, তারতুস এবং হামা অঞ্চলে আসাদ সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত সন্ত্রাসী অভিযানের ফলে একাধিক সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, যা বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, বিশেষ করে তুরস্ক, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ‘আলাউইতরা গণহত্যা চালাচ্ছে’ স্লোগানের অধীনে একটি প্রচারণা চালানো হয়, যা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বানে বাধ্য করে।

সংঘর্ষ শুধুমাত্র উপকূলীয় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না। উত্তর আলেপ্পোতে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (ওয়াইপিজি) এবং কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)-এর যোদ্ধারা শেখ মাকসুদ ও আশরাফিহ এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালায়, যা শহরের অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে, ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়া মিলিশিয়ারা এবং পিকেকে-ঘনিষ্ঠ কুর্দি আধাসামরিক গোষ্ঠীগুলো একত্রিত হতে শুরু করে। তবে ইরাকি সরকার এবং তুরস্ক তাদের সিরিয়ায় প্রবেশে বাধা দেয়। এ থেকেই বোঝা যায়, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন গোলযোগ নয়। বরং সিরিয়ার সরকারকে উৎখাতের একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা।

অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণ
সিরিয়ায় সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। তা হলো,

১. তুর্কি-সৌদি জোটের কার্যকর প্রতিরোধ
নতুন সিরিয়ার সরকার শক্তিশালী তুরস্ক ও সৌদি আরবের সমর্থন পেয়েছিল। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরপরই তুরস্কের যুদ্ধবিমান ইরাকি-সিরিয়ান সীমান্তে টহল দেয়, যাতে কুর্দি গোষ্ঠী এবং শিয়া মিলিশিয়ারা সিরিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে। পাশাপাশি তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান দামেস্ক সফর করে সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানান। সৌদি আরবও সিরিয়ার সরকারকে সমর্থন ঘোষণা করে, যা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

২. সিরিয়ার সরকারের দক্ষ সঙ্কট ব্যবস্থাপনা
সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরপরই আহমেদ আল-শারা বেসামরিক হতাহতের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। একইসাথে কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়, যা আলাউত সংখ্যালঘুর মধ্যে আস্থা বাড়ায় এবং সংঘর্ষকে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়া থেকে রক্ষা করে।

৩. আম্মান চুক্তির তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব
সহিংসতার আগের দিনই তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও জর্ডান আম্মানে বৈঠক করে আইএসআইএসের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া সীমান্ত নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে সহযোগিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, যা সিরিয়ার সরকারকে অতিরিক্ত কূটনৈতিক শক্তি জোগায়।

৪. ইসরাইল-মার্কিন দ্বন্দ্ব
গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের হামাসের সাথে সরাসরি আলোচনার ফলে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টানাপোড়েন বৃদ্ধি পায়। এই দ্বন্দ্ব সিরিয়ার অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার কৌশলগত সহায়তাকে দুর্বল করে।

৫. পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা
সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক সমীকরণ পরিবর্তিত হওয়ায় ইসরাইল ও মার্কিন-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো অভ্যুত্থান পরিকল্পনা কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়। তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তি সিরিয়ার অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

৬. ইউরোপীয়-আমেরিকান নীতি বিভাজন
ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে ইউরোপের বাণিজ্য দ্বন্দ্বের ফলে ইউরোপ তুরস্কের দিকে আরো ঘনিষ্ঠ হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গাজা এবং সিরিয়ার অস্থিরতা নিয়ে মার্কিন নীতির বিরোধিতা করে। ইউরোপ আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সহিংসতার নিন্দা জানায়, যা সিরিয়ার সরকারের প্রতি তাদের স্পষ্ট সমর্থন প্রকাশ করে।

সিরিয়ার জনগণ যুদ্ধক্লান্ত এবং স্থিতিশীলতা চায়। আহমেদ আল-শারার সরকারের প্রতি তাদের ক্রমবর্ধমান সমর্থন এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক শক্তির অবস্থান পরিবর্তনের ফলে সিরিয়ার অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা এখন আগের মতো সহজ নয়।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top