মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সম্প্রতি সিরিয়ার উপর আরোপিত কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। এর লক্ষ্য সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার শাসনব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করা এবং দামেস্কের সাথে একটি নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অবস্থানকে পুনর্গঠন করা।
তবে এই নীতিগত পদক্ষেপ ইসরাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির থেকে স্পষ্ট বিচ্যুতি নির্দেশ করে। একদিকে, ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়াকে কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখে এসেছে এবং এর দুর্বলতা ও বিভাজনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন এই নতুন শাসনকে সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে দেখছে। বিশেষ করে সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে ভবিষ্যত সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সম্ভাবনাকে তারা সামনে রাখছে।
তাদের পারস্পরিক এই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের পেছনে চারটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। আমরা তা নিম্নে তুলে ধরছি।
১. কৌশলগত পুনর্গঠন ও নতুন মিত্র সৃষ্টির সুযোগ
ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে সিরিয়ার নতুন সরকারকে সমর্থন করা একটি ঐতিহাসিক সুযোগ, যা কয়েক দশক ধরে ইসরাইল-বিরোধী অবস্থানে থাকা দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রে রূপান্তর করতে পারে। এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার কৌশলগত প্রভাব বাড়াতে সহায়ক হবে। প্রতিবেশী দেশ লেবানন ও ইরাকেও তার প্রভাব বিস্তারে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। পক্ষান্তরে ইসরাইল সিরিয়াকে দুর্বল করে রাখতে চায়। সেজন্য ট্রাম্পের এই নীতি তাদের সেই পরিকল্পনার পরিপন্থী হচ্ছে।
২. আঞ্চলিক মিত্রদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো
ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি ভূমিকা কমিয়ে সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো আঞ্চলিক মিত্রদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে চান। সিরিয়াকে এই নতুন শৃঙ্খলার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা ওয়াশিংটনের কৌশলগত লক্ষ্য। তবে ইসরাইল তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবকে হুমকি হিসেবে দেখে। সেজন্য এই অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের দৃষ্টিভঙ্গি আরো দূরত্বে চলে যাচ্ছে।
৩. স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রয়াস
ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গৃহযুদ্ধ বা বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে আইসিসের মতো গোষ্ঠীর উত্থানের ঝুঁকি বাড়বে। এটি রাশিয়া ও ইরানের প্রভাব ফিরে আসার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এর কারণে তুরস্ক-ইসরাইল উত্তেজনাও সামরিক সঙ্ঘাতে রূপ নিতে পারে। তাই মার্কিন নীতি এই ঝুঁকিকে হ্রাস করতে চাইলেও ইসরাইল তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সেটিকে উল্টোভাবে উস্কে দিচ্ছে।
৪. দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তির লক্ষ্যে সিরিয়া-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ
ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বাস করে যে সিরিয়াকে পশ্চিমা ঘরানায় অন্তর্ভুক্ত করা দীর্ঘমেয়াদে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিতে পারে। যদিও ইসরাইল আপাতত নতুন সরকারের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করছে। তবু সিরিয়া-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সম্ভাবনা তাদের কৌশলগত স্বার্থেও সহায়ক হতে পারে।
ইসরাইলি অবস্থানে পরিবর্তনের ইঙ্গিত
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির প্রভাবে ইসরাইলি অবস্থানে কিছু পরিবর্তনের লক্ষণও স্পষ্ট হয়েছে। যেমন সিরিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলি সামরিক কার্যক্রম হ্রাস পেয়েছে; নতুন সরকারের সাথে পরোক্ষ আলোচনার পর মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে; তুরস্কের সাথে সিরিয়ায় উত্তেজনা কমাতে ইসরাইলের সংলাপ শুরু হয়েছে।
তবে ইসরাইলের অবস্থান কতটা স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র-সিরিয়া সম্পর্কের গতিপথের ওপর।
ছয় মাসের পরীক্ষামূলক সময়কাল
সিরিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন ছয় মাসের একটি সময়কাল নির্ধারণ করেছে, যা একদিকে নতুন সরকারের ওপর আস্থা যাচাই করার সুযোগ, অন্যদিকে ইসরাইলের নিরাপত্তা উদ্বেগ মেটাতে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রও তৈরি করবে।
যদিও অদূর ভবিষ্যতে সিরিয়া-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন। তবে সিরিয়ায় মার্কিন সম্পৃক্ততা বর্তমানে ইসরাইলি চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এতে প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার শাসন ব্যবস্থার জন্য অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ সুগম হতে পারে। পাশাপাশি এটি তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যে সম্ভাব্য সঙ্ঘাতের ঝুঁকি কমিয়ে এক যৌথ কৌশল নির্ধারণের সুযোগও এনে দিতে পারে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ট্রাম্প সিরিয়াকে একটি নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করতে চান, যা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ধরে রাখবে। তবে সেজন্য তারা তা সরাসরি সামরিক উপস্থিতি কমানোর মাধ্যমে করতে চান।
সূত্র : আল জাজিরা