সুদান ইসরাইল সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থের বিনিময়ে কোনও চুক্তি হচ্ছে না বলে সরাসরি অস্বীকার করেছে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী ইউসুফ আল-শরিফ।
তুরস্কে অনুষ্ঠিত আন্টালিয়া কূটনৈতিক ফোরামে মিডল ইস্ট আই–কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “সুদান ইসরাইল সম্পর্ক নিয়ে আমরা কোনো কিছু করার চেষ্টা করছি না। আমার কাছে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে কোনও তথ্য নেই। সাম্প্রতিক সময়ে কোনও যোগাযোগও হয়নি।”
তবে এর আগে সুদানের সামরিক প্রধান আল-বুরহান–এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী লেফটেন্যান্ট জেনারেল আল-সাদিক ইসমাইলের তেল আবিব সফর ও সুদান ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার খবর প্রকাশ করে আল-রাকোবা।
সুদান যুদ্ধ : আরএসএফকে সমর্থনের কারণে আমিরাতকে বয়কটের আহ্বান প্রবাসী কর্মীদের
সুদান ইসরাইল সম্পর্ক কেমন
২০২১ সালে আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষর করলেও অভ্যন্তরীণ সংকট—বিশেষত গৃহযুদ্ধ, RSF প্রধান হেমেতি এবং আল-বুরহান–এর মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে সুদান ইসরাইল সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়নি।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বুরহানকে মার্কিন প্রশাসনের কাছে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে উত্তেজনা মোকাবেলার লক্ষ্যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন ইসমাইল। তিনি নাকি জানান, বুরহান সুদান ইসরাইল সম্পর্ক চূড়ান্ত করতে প্রস্তুত। এর বিনিময়ে তিনি বিনিময়ে ইসরাইলি সমর্থন চায়।
তবে এসব দাবিকে ‘সরকারের নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “যদি ইসমাইল সত্যিই সুদান ইসরাইল সম্পর্ক স্থাপনে তেল আবিবে সফর করে থাকেন, সেটি অনুমোদিত কোনও পদক্ষেপ নয়।” তিনি আরও বলেন, “যেমন গাজা শরণার্থী আশ্রয় নিয়ে কোনও যোগাযোগ হয়নি, এটিও তেমনই একটি প্রচার।”
সুদান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও শরীফ জানান, ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ চলছে এবং গৃহযুদ্ধ ও মানবিক সংকট নিয়ে আলোচনা করতে একটি মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফর প্রত্যাশা করছে খার্তুম।
সুদান : প্রচারহীন এক গণহত্যার উপাখ্যান
আইসিজে-তে আমিরাতের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ
দারফুরে গণহত্যার অভিযোগে সুদান সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত–এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) মামলা করেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, RSF বাহিনী মাসালিত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে সহিংসতা চালিয়েছে, তা আমিরাতের সমর্থন ছাড়া সম্ভব হতো না।
তবে গণহত্যা কনভেনশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আপত্তি থাকায় আইসিজে মামলাটি খারিজ করে দিতে পারে।
তবুও শরীফ আশাবাদী। তার মতে, রায় বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে আইসিজে রায় গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি শুনানি না হলেও, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি তোলা হবে।
তিনি আরও দাবি করেন, সুদান ইতোমধ্যে শক্ত প্রমাণ পেশ করেছে—যার মধ্যে রয়েছে RSF বাহিনীর কাছে আমিরাত হয়ে পৌঁছানো মার্কিন অস্ত্র। এসব অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়াই স্থানান্তর হয়েছে এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ব্যবহার করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী ও আরএসএফের গৃহযুদ্ধ
সুদানে সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া নৃশংস গৃহযুদ্ধ এখন দুই বছর অতিক্রম করেছে। এই সংঘর্ষ এখন শুধু সামরিক পর্যায়েই থাকেনি। বরং রূপ নিয়েছে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে। বিশ্বের যেসব বিপর্যয় গণমাধ্যমে কম কভারেজ পেয়েছে, সুদানের সঙ্কটটি এর মধ্যে অন্যতম। অথচ এই সঙ্কটে ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। বহু অঞ্চল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে গোটা জাতি। এর মধ্য দিয়ে সুদান হয়ে ওঠেছে প্রচারহীন এক গণহত্যার উপাখ্যান।
প্রচারহীন এক গণহত্যার উপাখ্যান
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুদানে যুদ্ধ চলাকালে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। অসংখ্য মানুষ যুদ্ধ, রোগ এবং দুর্ভিক্ষের কারণে প্রাণ হারিয়েছে। দেশজুড়ে চরম অপুষ্টি এবং জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে। যুদ্ধের ফলে পূর্ব ও মধ্যাঞ্চল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল অধিকাংশই আরএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন
উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। বিশেষ করে খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা, নির্বিচারে মানুষ হত্যা এবং বিচারবহির্ভূত নির্যাতন এর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু আরএসএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আরো গুরুতর। তারা পশ্চিম দারফুরে চালাচ্ছে গণহত্যা। সংঘবদ্ধ করছে নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণ, পুরো সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে করছে পরিকল্পিত হামলা।
এই সঙ্ঘাত প্রথম দিকে ছিল দুই সশস্ত্র বাহিনীর লড়াই। কিন্তু এখন তা সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে এক বর্বর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
সুদানের জনগণের এই দীর্ঘ, নীরব যন্ত্রণা বিশ্বের কাছে প্রায় অদৃশ্য। অথচ বাস্তবতা ভয়াবহ। লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুতি, দুর্ভিক্ষ, গণহত্যা, সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ, বিচ্ছিন্ন পরিবার এবং চূড়ান্ত হতাশা। এই রিপোর্টে উঠে এসেছে সেসব কণ্ঠস্বর, যাদের না বলা গল্প বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হওয়া উচিত।
এই যুদ্ধ শুধু একটি দেশের নয়, মানবতার পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি। সুদান এখন কেবল একটি দেশের নাম নয়। এটি প্রচারহীন এক গণহত্যার উপাখ্যান।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই




