আল-শাবাবের সাম্প্রতিক আক্রমণের প্রেক্ষিতে সোমালিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতি প্রায় দ্বিগুণ করেছে তুরস্ক। মোগাদিশুর দক্ষিণে আল-শাবাবের অগ্রগতির জেরে নিরাপত্তা উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ায় আঙ্কারা এমন সিদ্ধান্ত নেয় বলে মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
গত মাসে আল-শাবাব মধ্য সোমালিয়ায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে এবং রাজধানী মোগাদিশুর দক্ষিণে কয়েকটি কৌশলগত গ্রাম দখল করে। এসব অঞ্চল সোমালি বাহিনীর জন্য বাফার জোন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা রাজধানীকে গাড়ি বোমা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী হামলা থেকে রক্ষা করে।
তুরস্কসমর্থিত সোমালিয়া ইথিওপিয়া চুক্তির নেপথ্য কূটনীতি ও ভূরাজনীতি
আল-শাবাবের হামলার পর তুরস্কের সেনা মোতায়েন দ্বিগুণ
এই সপ্তাহে তুরস্ক সোমালিয়ায় অতিরিক্ত ৫০০ সৈন্য মোতায়েন করেছে, যা পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ। মোতায়েনকৃত বাহিনীকে মূলত মোগাদিশুর তুর্কসোম ঘাঁটি রক্ষা, সশস্ত্র ড্রোন পরিচালনা এবং বন্দর সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের প্রথম মানবিক সফরের পর থেকেই তুরস্ক সোমালিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে। সময়ের সঙ্গে এই সম্পর্ক বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তাভিত্তিক অংশীদারিত্বে রূপ নিয়েছে। তুর্কি কোম্পানিগুলি বর্তমানে মোগাদিশুর বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করে এবং তুরস্কের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি সংস্থাগুলি স্থল ও সমুদ্রে অনুসন্ধান অভিযান পরিচালনা করছে।
আঙ্কারা আনুষ্ঠানিকভাবে সোমালিয়ার আঞ্চলিক জলসীমা রক্ষা এবং উপকূলীয় সম্পদ আহরণে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মার্চ মাসে আল-শাবাবের সাফল্যের পর সোমালি প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মোহাম্মদ তুরস্ক সফর করেন এবং রাষ্ট্রপতি এরদোগানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। যদিও বৈঠকের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি, এটি আঙ্কারার সম্ভাব্য সামরিক সহায়তার ইঙ্গিত দেয়।
মার্কিন চাপে সোমালিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত
আল-শাবাবের অগ্রগতির পেছনে সোমালি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকেই দায়ী করছেন আঙ্কারার অনেক নীতিনির্ধারক। তাদের মতে, বিরোধী দলগুলো সরকারের দুর্বলতা চায় এবং আল-শাবাবের তৎপরতা উপেক্ষা করছে।
তুর্কি সামরিক সূত্র জানিয়েছে, মোগাদিশুতে ৩০০ তুর্কি কমান্ডো মোতায়েন করা হয়েছে মূলত ঘাঁটি রক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সহায়তার জন্য। পাশাপাশি অতিরিক্ত ২০০ জন সদস্য সশস্ত্র ড্রোন পরিচালনার কাজে যুক্ত হয়েছে। আগে থেকেই মোতায়েন থাকা TB2 Bayraktar ড্রোনের পাশাপাশি এবার দুটি উন্নত আকিনসি ড্রোনও মোতায়েন করেছে তুরস্ক, যেগুলো দীর্ঘ সময় ধরে উড়তে সক্ষম এবং রাতেও কার্যকর।
“আকিনসি ড্রোনগুলি রাতে কার্যক্রম চালানো আল-শাবাব যোদ্ধাদের ধরতে বেশি উপযোগী,” জানিয়েছে একটি সূত্র।
সোমালিয়ায় ইসরাইলি রাডার মোতায়েন সংযুক্ত আরব আমিরাতের
তবে তুরস্কের সরাসরি যুদ্ধের পরিকল্পনা নেই বলেই জানিয়েছে আরেক সূত্র। কারণ, আল-শাবাবের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে তুর্কি সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন। তুর্কি সেনারা শুধুমাত্র সম্পদ রক্ষা এবং প্রয়োজনে আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়বে।
একজন ঊর্ধ্বতন তুর্কি কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে সোমালিয়ার আকাশসীমা মার্কিন আফ্রিকা কমান্ডের (Africom) নিয়ন্ত্রণে। তাই সব তুর্কি বিমান অভিযান তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই পরিচালিত হয়।
গুজব রয়েছে, তুরস্ক সোমালিয়াকে T-129 আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার দিয়েছে। তবে সোমালি সূত্র জানিয়েছে, এখনো পাইলটদের প্রশিক্ষণ চলছে এবং এ বছরের শেষ দিকে তারা এসব হেলিকপ্টার পরিচালনায় সক্ষম হবে।
আরেকটি সূত্র জানায়, তুরস্ক ইস্পার্টা ও ইজমিরে প্রশিক্ষিত সোমালি সেনা মোতায়েন চালিয়ে যাবে। এর পাশাপাশি কাতারও মোগাদিশুতে অতিরিক্ত গোলাবারুদ পাঠিয়েছে।
“প্রয়োজনে তুরস্ক আরও ড্রোন এবং আর্টিলারি সহায়তা পাঠাবে,” যোগ করেন সূত্রটি।
উল্লেখ্য যে মার্কিন সামরিক বাহিনীর তদবিরের সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মোহাম্মদ রোববার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবদুল কাদির মোহাম্মদ নূরকে বরখাস্ত করেছেন।
সূত্রমতে, মার্কিন সহায়তা ধীর হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতের পরিপ্রেক্ষিতে সোমালিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করে বন্দরমন্ত্রী হিসেবে পুনর্নিযুক্ত করা হয়েছে।
পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত দু’টি সূত্র মিডল ইস্ট মনিটর-কে জানায়, নূরের নেতৃত্বে তুরস্কের সাথে সামরিক, জ্বালানি এবং মহাকাশ খাতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার চেষ্টা ওয়াশিংটনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন প্রশাসন আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি সোমালিয়া-তুরস্ক সম্পর্কের বিস্তারকে সন্দেহের চোখে দেখছে।
নূরের নেতৃত্বে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়া ও তুরস্ক একটি বিস্তৃত নৌ, বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। যদিও চুক্তির পুরো বিবরণ গোপন রাখা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এতে তুরস্ককে সোমালির জলসীমা রক্ষা, একটি জাতীয় নৌবাহিনী গঠন এবং জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানে সহায়তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপটি ইথিওপিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্ন অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের সাথে সাম্প্রতিক নৌচুক্তির জবাব হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে।
আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও সাবলীল তুর্কি ভাষাভাষী আবদুল কাদির মোহাম্মদ নূর দীর্ঘদিন ধরে তুর্কি নেতৃত্বের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
মিডল ইস্ট মনিটরকে এক সোমালি কর্মকর্তা জানান, মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা সোমালিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদকে একাধিকবার চাপ দেন। তাদের অভিযোগ ছিল, নূর মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ে ঘাটতি রাখছিলেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, তারা ফেব্রুয়ারির চুক্তির কনটেন্টে প্রবেশাধিকারও দাবি করেছিল, এই আলোচনাগুলো সারা বছর জুড়ে একাধিকবার হয়েছে, তদবিরের মাত্রা বাড়তেই থাকে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, তুরস্কের পরিকল্পনায় সোমালিয়ায় একটি মহাকাশ বন্দর স্থাপন ও সম্ভাব্য রকেট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা ওয়াশিংটনের উদ্বেগ বাড়িয়েছিল। মার্কিন কর্তৃপক্ষ একে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঝুঁকি হিসেবে দেখেছে। পাশাপাশি, সোমালি ভূখণ্ডে তুরস্কের জ্বালানি অনুসন্ধান উদ্যোগও মার্কিন অসন্তোষের আরেকটি কারণ হয়ে ওঠে।
আল-শাবাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তুরস্ক সম্প্রতি মোগাদিশুতে দুটি সশস্ত্র বায়রাকতার আকিনসি ড্রোন মোতায়েন করে। এটি ছিল সোমালিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ঠিক আগের চূড়ান্ত পদক্ষেপ।
আমেরিকানরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, যদি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে না সরানো হয়, তবে তারা আল-শাবাববিরোধী নিরাপত্তা সহযোগিতা পুনর্বিবেচনা করবে, জানিয়েছেন দ্বিতীয় সূত্রটি।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই