“দ্য হোয়াইট হাউস অন উবার: হাউ টু প্রি-পারচেজ আ ইউএস প্রেসিডেন্ট” নামের টেলিভিশন গেম শোর সাম্প্রতিক পর্বে, এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল উপস্থাপক যেন হঠাৎ সত্যিকার স্ক্রিপ্ট পড়ে ফেলেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবে এক ভাষণে বলেছিলেন, উদার হস্তক্ষেপবাদ ছিল এক ভয়াবহ ব্যর্থতা। তিনি আরও বলেন, কোনো জাতিকে ধ্বংস করে তাকে নতুন করে গড়ে তোলা যায় না। সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও ইয়েমেন—এই পাঁচটি দেশই তার প্রমাণ।
ট্রাম্প ইয়েমেনে মার্কিন বিমান হামলা বন্ধ করেছিলেন এবং সিরিয়ার ওপর দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। এর ফলে ইসরায়েলের দুটি প্রধান কৌশলগত পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়—একটি ছিল সিরিয়াকে ভেঙে ফেলা, অন্যটি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করা।
তবে আমি বলেছি ‘এক মুহূর্তের জন্য’, কারণ ইরান নিয়ে অতীতে বহুবার দেখা গেছে—মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যা প্রতিশ্রুতি দেন, বাস্তবে করেন ঠিক তার উল্টো। ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণায় বিস্মিত হয়েছিলেন এমনকি মার্কিন ট্রেজারির নিজস্ব কর্মকর্তারাও।
১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়াকে ‘সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার পর থেকে নিষেধাজ্ঞার স্তর এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে সেগুলো সহজে বা দ্রুত তুলে নেওয়া সম্ভব নয়।
বর্তমানে বলবৎ ‘সিজার সিরিয়ান সিভিলিয়ান প্রটেকশন অ্যাক্ট’ কংগ্রেসীয় আইন, যা বাতিল করতে কংগ্রেসের সম্মতি প্রয়োজন। যদিও ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তিতে এর কিছু অংশ সাময়িকভাবে স্থগিত করতে পারেন, তবু পুরো নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। এই প্রক্রিয়ায় যেকোনো সময় নতুন বাঁক আসতেও পারে।
এই পর্বে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতার প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থব্যয় করেছে—যা উপসাগরীয় অঞ্চলের মানদণ্ডেও অভাবনীয়।
ধন-অস্ত্রের খেলা
সৌদি আরব প্রতিশ্রুতি দেয় ৬০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি। কাতারের সঙ্গে হয় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের সমঝোতা। ট্রাম্পের জন্য বরাদ্দ হয় একটি ব্যক্তিগত বোয়িং ৭৪৭ বিমান, দুবাইয়ে তাঁর ছেলে এরিক ট্রাম্পের নামে একটি বহুতল ভবন, এবং ট্রাম্প পরিবারের প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফাইন্যান্সিয়ালের সঙ্গে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি চুক্তি।
ধনী আরব শাসকেরা যেন একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছিলেন—কে হোয়াইট হাউসের এই নতুন অধিপতিকে বেশি তুষ্ট করতে পারেন।
এই লোভনীয় চুক্তির মুহূর্তে, যখন রিয়াদ ও দোহা ছিল আলোর ঝলকে ভরপুর, তখন গাজায় ইসরায়েল উদযাপন করছিল ১৯৪৮ সালের নাকবার বার্ষিকী—যত বেশি সম্ভব ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে।
ইসরায়েলের একতরফা যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর, ওই বুধবার ছিল গাজার অন্যতম ভয়াবহ দিন। প্রায় ১০০ জন নিহত হন। খান ইউনিসের ইউরোপীয় হাসপাতালের নিকট ফেলা হয় বাঙ্কার-বাস্টিং বোমা। লক্ষ্য ছিলেন হামাসের ডি-ফ্যাক্টো নেতা মুহাম্মদ সিনওয়ার। তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত নয়।
তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যার প্রচেষ্টার মতোই, ইসরায়েল এই হামলা চালায় এমন একটি সময়ে, যখন তারা নিজেই আলোচনার দাবি জানাচ্ছিল।
সূত্র জানায়, ১৮ মার্চ—ইসরায়েলের আক্রমণ পুনরায় শুরুর ঠিক আগে—হামাসের প্রবাসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। এতে যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর বিনিময়ে কিছু জিম্মি মুক্তির শর্ত ছিল। তবে যুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার নিশ্চয়তা ছিল না। সিনওয়ার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, ফলে আলোচনা থেমে যায়।
যদি সত্যিই তিনি নিহত হন, তাহলে হামাসের অভ্যন্তরে নিরাপদ যোগাযোগ ও নেতৃত্বের কাঠামো পুনরায় গড়ে তুলতে সময় লাগবে। তাঁর বিকল্প হিসেবে কাকে বেছে নেওয়া হবে—তা নির্ধারণ করাও হবে সময়সাপেক্ষ।
এই হত্যাচেষ্টা বা তাঁর সম্ভাব্য মৃত্যু আরও একবার প্রমাণ করে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বাকি জিম্মিদের জীবিত ফেরানোর আদৌ কোনো আগ্রহ নেই। কারণ কোনো কার্যকর জিম্মি চুক্তির জন্য হামাসের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণের কাঠামো টিকে থাকা জরুরি। শুধু গেরিলা যুদ্ধের জন্য তা প্রয়োজন নয়।
নেতানিয়াহুর গাজা মিশন—২১ লাখ মানুষের ওপর অনাহার চাপিয়ে দেওয়া, লাগাতার বোমা বর্ষণ—এতটাই নগ্ন ও স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক মহলও তা আর উপেক্ষা করতে পারছে না।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি টম ফ্লেচার নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, “যারা নিহত হয়েছেন, যাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের স্মরণে আর কত প্রমাণ দরকার? আন্তর্জাতিক মানবিক আইন রক্ষায় কি আপনি এখনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত নন?”
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গাজায় ইসরায়েলের নীতিকে “লজ্জাজনক” আখ্যা দেন। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ স্প্যানিশ পার্লামেন্টে বলেন, “আমরা একটি গণহত্যাকারী রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করি না।”
বিশ্বাসঘাতকতা যাদের রক্তে
তবে এই ভয়াবহ নিপীড়নের পরেও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ কিংবা কাতারের আমির শেখ তামিম—তাঁদের কেউই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি।
উপসাগরীয় এই নীরবতা এবং সহযোগিতা ছিল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা। তবে তারা জানে, আরব শাসকদের হাতে বারবার পরিত্যক্ত হওয়ার ইতিহাস তারা বহন করে চলেছে বহু প্রজন্ম ধরে।
পরাজয়ের পর প্রতিক্রিয়া ও বর্তমান বিপর্যয়
অতীতে সামরিক পরাজয়ের পর প্রতিক্রিয়ায় আরব নেতারা প্রায়ই মাস বা বছর অপেক্ষা করতেন।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরও, পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা উঠতে সময় লেগেছিল।
আজ, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা আরব বিশ্বের প্রকৃত নায়কদের পরিত্যাগ করছে—যারা অনাহারে কাতর এবং আকাশ থেকে বর্ষিত বোমার নীচে প্রাণ হারাচ্ছে।
হামাস ও হিজবুল্লাহ—উভয়ই আজ চরমভাবে ক্ষতবিক্ষত।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, তাদের প্রতিরোধ কি সত্যিই শেষ হয়েছে?
হামাস এখনো যুদ্ধের ময়দানে সক্রিয়, যার প্রমাণ ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোপন রাখা হতাহতের সংখ্যা।
এমনকি কোনো একক রক্ষীও নিজের জীবন বাঁচাতে গিয়ে তাদের জিম্মিদের ছেড়ে দেয়নি।
গাজায় প্রতিরোধের চেতনা আজও অক্ষুন্ন।
বরং, এই সংগ্রাম ফরাসি ও মার্কিন ঔপনিবেশিক শক্তির আরও একটি ঐতিহাসিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
গাজা ও ভিয়েতনাম: তুলনাহীন কিন্তু মিল রয়েছে
গাজা ও ভিয়েতনামের যুদ্ধের মধ্যে সরাসরি তুলনা করা যায় না।
তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—আজ গাজায় ইসরাইল যে ধ্বংসাত্মক শক্তি প্রয়োগ করছে, তা ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে জন এফ কেনেডি, লিন্ডন বি জনসন ও রিচার্ড নিক্সনের আমলে ভিয়েতনামে ব্যবহৃত শক্তিকেও ছাড়িয়ে গেছে।
ভিয়েতনামে আট বছরে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লক্ষ টনেরও বেশি বোমা ফেলেছিল, যা এটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক বোমাবর্ষণপ্রাপ্ত এলাকা করে তোলে।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যেই ইসরাইল গাজায় ফেলেছে অন্তত ১ লক্ষ টন বোমা।
পরিসংখ্যানে যদি বলা যায়—ভিয়েতনামে প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ১৫ টন বিস্ফোরক বর্ষিত হয়েছিল।
গাজায় সেই পরিমাণ ২৭৫ টন, যা ভিয়েতনামের তুলনায় ১৮ গুণ বেশি।
এই তথ্য কেবল যুদ্ধের মাত্রা নয়, বরং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে গাজার স্থায়ী দখল ও জনশূন্যকরণ প্রচেষ্টার গভীরতাও তুলে ধরে।
আমরা যেন এক নতুন দুঃস্বপ্নের মধ্যে পুরনো যুদ্ধের পরিচিত ছায়া দেখতে পাচ্ছি।
এক নিষ্ঠুর দেজা ভু: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
যারা ইতিহাস জানেন, তারা আজকের পরিস্থিতিতে এক ভয়ানক দেজা ভু অনুভব করেন।
নেটফ্লিক্সের *টার্নিং পয়েন্ট: দ্য ভিয়েতনাম ওয়ার* মিনিসিরিজ সেই স্মৃতিকে আরও জাগ্রত করে।
ভিয়েতনামে মার্কিন সামরিক অভিযানের অন্তসারহীনতা আজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ইসরাইলের হামাস নির্মূল প্রচেষ্টায়।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের শুরুতে, ওয়াশিংটন দাবি করেছিল—তাদের ১৬,০০০ সেনা ও পাইলট কেবল “পরামর্শদাতা”।
কিন্তু যুদ্ধ যখন তীব্রতর হয়, তখন বোঝা যায়, গ্রামাঞ্চলে ভিয়েতনামের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার না করলে এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়।
সেই পরিকল্পনায় ছিল প্রায় ১২,০০০ গ্রামের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
এই প্রেক্ষাপটেই আসে “কৌশলগত হ্যামলেট প্রোগ্রাম”।
গ্রামবাসীদের পূর্বপুরুষের জমি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের সুরক্ষিত শিবিরে রাখা হত।
তাদের বলা হতো, তারা এখানে থেকে কমিউনিস্ট প্রভাব মুক্ত একটি নতুন জীবন শুরু করতে পারবে।
কিন্তু বাস্তবে এই কর্মসূচি গ্রামবাসীদের ক্ষোভ ও প্রতিরোধকেই তীব্র করে তোলে।
‘মুক্ত-অগ্নিসংযোগ অঞ্চল’: শান্তির নামে গণহত্যা
সেই সময় মার্কিন সেনারা বেসামরিক নাগরিক ও যোদ্ধাদের মাঝে পার্থক্য করতে পারত না।
এই দুর্বলতা থেকে জন্ম নেয় ‘মুক্ত-অগ্নিসংযোগ অঞ্চল’ নীতি।
যেখানে যেকোনো ভিয়েতনামীকে—চেনা হোক বা না হোক—শত্রু ধরে গুলি করা যেত।
এক মার্কিন মেরিন স্মরণ করেন:
“আমাদের বলা হয়েছিল, যারা চলে যায় তারা নিরীহ, আর যারা থাকে তারা ভিয়েত কং।
তাদের খুঁজে বের করো, মেরে ফেলো—যেভাবেই পারো।”
ফেরার সময় সেনাদের কাছে ‘লাশের সংখ্যা’ চাওয়া হতো।
নারী-শিশু সবার লাশই “মৃত কমিউনিস্ট” হিসেবে গণ্য করা হতো।
আরেক ভিয়েতনাম যোদ্ধা বলেন:
“আমাদের বলা হয়েছিল—প্রতি একজন আমেরিকানের বদলে ১০ জন ভিয়েতনামীকে হত্যা করলেই আমরা জিতব।”
এদিকে, যেসব গ্রামবাসী “ভিয়েতনাম কং-মুক্ত” শিবিরে ছিল, তারা অনাহারে ভুগছিল।
ধানক্ষেতের প্রবেশাধিকার হারিয়ে তারা খাদ্য থেকে বঞ্চিত ছিল।
উদ্দেশ্য ছিল না তাদের খাওয়ানো—বরং তাদের স্থানচ্যুত করে এলাকা শূন্য করা।
ফলে, বহু গ্রামবাসী পালিয়ে শহরের দিকে আসে।
এই শহরগুলিতে ভিয়েতনাম কং-এর অবস্থান ছিল আরও শক্তিশালী।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের গ্রামবাসীদের ৭০ শতাংশই ছিল নারী।
জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের ট্রান থি ইয়েন নোক স্মরণ করেন:
“তারা আমাদের ভিয়েতনাম কং বলত, কিন্তু আমরা ছিলাম মুক্তিবাহিনী।
আমরা সবাই কমরেড ছিলাম, নিজেদের পরিবার মনে করতাম।
একজন মারা গেলে পাঁচ থেকে সাতজন নতুন করে যোগ দিত।”
দমন, অমানবিকতা ও বিদ্রোহ
১৯৬৮ সালের আরেকটি প্রতিচ্ছবি আমরা আজও দেখতে পাই।
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি ছিল দমনের নিষ্ঠুরতা।
একইসঙ্গে, যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল হিসেবে শত্রুকে অমানবিকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা এখনো চলমান।
ইসরাইল এবং মার্কিন সেনাবাহিনী আজও সেই নীতি অনুসরণ করছে—
যেখানে মানবিকতা বিলুপ্ত হয়, আর শত্রু পরিচিত হয় শুধুই এক “বস্তু” হিসেবে, ধ্বংসের লক্ষ্যমাত্রা।
১৯৬৮ সালের মাই লাই গণহত্যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৫০০ নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষ নিহত হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকান কমান্ডার জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমোরল্যান্ড মন্তব্য করেছিলেন, “প্রাচ্যবাসীরা জীবনের মূল্য পশ্চিমাদের মতো উচ্চভাবে দেয় না।”
ইসরাইলি নেতারা এই মনোভাবকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছেন। তারা ফিলিস্তিনিদের মানুষ বলেই গণ্য করেন না।
বিগত দশকের এসব নিষ্ঠুরতা আজকের গাজা ও পশ্চিম তীরের বাস্তবতার সঙ্গে ভয়ানকভাবে সাযুজ্যপূর্ণ।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর এক সাক্ষাৎকারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল (রিজার্ভ) গিওরা আইল্যান্ড বলেন, গাজায় কোনো সাহায্য প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়। তার ভাষায়, “মানবিক সহায়তা দিয়ে আমরা দুর্বলতা দেখাচ্ছি—এটা একটা গুরুতর ভুল। গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে হবে—চরম বিশৃঙ্খলা, মানবিক বিপর্যয়, স্বর্গের কাছে আর্তনাদ। এটাই হওয়া উচিত।”
পরে তিনি যুক্তি দেন, “গাজার সবাই যেন ক্ষুধার্ত হয়। তখন ক্ষুব্ধ জনগণ নিজেরাই \[ইয়াহিয়া] সিনওয়ারের বিরুদ্ধে উঠবে। আর এটাই তাকে দুর্বল করবে।”
এই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ পায়নি। কিন্তু আইল্যান্ডের এই কৌশল ‘জেনারেলদের পরিকল্পনা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রথমে এটি উত্তর গাজায় কার্যকর করা হয়, যেখানে প্রায় ৪ লাখ ফিলিস্তিনি অবস্থান করছিল।
তবে উত্তর গাজা খালি করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির সময় বহু মানুষ ফিরে আসে, যদিও তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
একমুখী টিকিট
ইসরাইলের চলমান সামরিক অভিযান, “গিডিয়নের রথ”, নতুন করে খাদ্য সংকট ও নিশ্চিহ্ন করার কৌশলকে জীবিত করেছে। নেতানিয়াহু একে যুদ্ধের “চূড়ান্ত পর্যায়” বলে অভিহিত করছেন। লক্ষ্য—রাফাহ এলাকার দুই মিলিয়নের বেশি ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক একটি নতুন “জীবাণুমুক্ত অঞ্চলে” পাঠানো।
এই এলাকায় প্রবেশ করতে হলে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি অতিক্রম করতে হবে। একবার ঢুকলে আর ফেরার সুযোগ থাকবে না। তাদের ঘরবাড়ি ইতোমধ্যেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইয়নেট এক প্রতিবেদনে জানায়, “ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও শিন বেট রাফাহ এলাকায় গাজার বেসামরিক নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য প্রধান সড়কগুলোয় চেকপয়েন্ট বসাবে।”
মঙ্গলবার নেতানিয়াহু বলেন, তিনি গাজায় একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে পারেন, তবে যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি তিনি দেবেন না।
ভিয়েতনাম যেমন এলবিজে ও নিক্সনের জন্য রাজনৈতিক মৃত্যুপর্বে পরিণত হয়েছিল, গাজাও নেতানিয়াহু ও তার উত্তরসূরি—সম্ভবত নাফতালি বেনেটের জন্য সেই রূপ নেবে। ব্রিটিশ সূত্র বলছে, নেতানিয়াহু এখন শারীরিক অসুস্থতার চেয়েও গভীর রাজনৈতিক সংকটে আছেন।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল দুটি কারণে—ভিয়েতনামিদের অদম্য মনোবল এবং আমেরিকান জনমতের পরিবর্তন। ঠিক এই একই দুই শক্তি ফিলিস্তিনিদেরও তাদের রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমিতে মরতেও রাজি। সেইসঙ্গে পশ্চিমা জনমতও দ্রুত ইসরাইলের বিরুদ্ধে ঝুঁকছে। এই পরিবর্তন এখন শুধু বামপন্থী মহলেই নয়, ডানপন্থার ভেতরেও প্রবেশ করছে।
গণহত্যার সমালোচনাকে আর ‘ইহুদি-বিরোধিতা’ বলে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সে অস্ত্র এখন ভোঁতা হয়ে গেছে।
এই যুদ্ধ কেবল ফিলিস্তিনের মাটি নয়, পশ্চিমাদের হৃদয় ও মনের ভেতরেও চলছে—সেখান থেকেই তো ইহুদিবাদী প্রকল্পটি জন্ম নিয়েছিল এবং এখনও টিকে আছে।
ইসরাইল প্রতিটি যুদ্ধ ময়দানে জিততে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধেই হারবে—যেমন আমেরিকাও ভিয়েতনামে হেরেছিল।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই