নেতানিয়াহু, ভ্যাটিকান

গাজায় নেতানিয়াহুর লক্ষ্য : হামাসের পতন নাকি ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন?

গাজায় ইসরাইলের চলমান সামরিক আগ্রাসন বিশ্বজুড়ে নিন্দার মুখে পড়েছে। যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার আহ্বান জানানো হলেও ইসরাইল তা উপেক্ষা করে রক্তক্ষয়ী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি হামাস প্রকাশ্যে যুদ্ধ সমাপ্তির লক্ষ্যে একটি চুক্তিতে আগ্রহ দেখিয়েছে এবং গাজায় শাসনভার একটি নিরপেক্ষ, টেকনোক্র্যাটিক সরকারের হাতে হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে।

হামাসের পতন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য নয়

জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির পক্ষে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে তা পাস হয়নি। অন্যদিকে, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সব ধরনের শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন যদি না তাতে ‘হামাসের পূর্ণ পরাজয়’ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এমন অবস্থান তিনি বজায় রেখেছেন, যাতে গাজায় আটক ইসরাইলিদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।

লেখক ও বিশ্লেষক এলিয়া আইয়ুবের মতে, এখন পর্যন্ত যে বাস্তবতা আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে, তাতে স্পষ্ট যে এই গণহত্যা অব্যাহত রাখার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো, নেতানিয়াহু চান যুদ্ধ থামুক না। এটি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য কেবল একটি অজুহাত মাত্র।

নেতানিয়াহুর এই যুদ্ধজেদ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত এই দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন, যুদ্ধ শেষ হলে ৭ অক্টোবরের নিরাপত্তা ব্যর্থতার দায়ভার তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে।

আইনজ্ঞ ও বিশ্লেষক ডায়ানা বুট্টু বলেন, নেতানিয়াহু গভীরভাবে আশঙ্কা করছেন, যুদ্ধ থামলেই তার দুর্নীতির মামলা ও নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য জনগণের দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ হবে।

রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার এই প্রয়াসে নেতানিয়াহু দু’টি উদ্দেশ্য সামনে রেখে এগোচ্ছেন: যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা এবং নিজেকে রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখা।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মাইরাভ জোনসেইনের ভাষায়, পুরো যুদ্ধজুড়েই নেতানিয়াহু হামাসের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করেছেন। তার মতে, ডানপন্থী ইসরাইলি রাজনীতি ও নেতানিয়াহু ধারাবাহিকভাবে হামাসকে একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যেন তারা কোনো আলোচনা বা যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত থাকেন।

ইতোমধ্যেই হামাসের সামরিক কাঠামো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত আট মাসে গাজায় একের পর এক শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। ইসরাইল দাবি করছে, সিনওয়ারের ছোট ভাই মোহাম্মদও নিহত হয়েছেন, যদিও হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে তা নিশ্চিত করেনি।

অন্যদিকে, হামাস গাজার শাসন থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে এবং একটি নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনায় আগ্রহ দেখিয়েছে। এই প্রস্তাব রাফা অভিযানের আগেই আলোচনায় আসে। বিশ্লেষক হামজে আত্তারের ভাষায়, ইসরাইল চায়, হামাস যেন অস্ত্র রেখে সবকিছু ছেড়ে দেয়। আর হামাস প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, ‘আমরা চলে যাচ্ছি।’

তবুও ইসরাইল এই প্রস্তাবগুলোকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং যুদ্ধোত্তর গাজার জন্য কোনো সুসংহত পরিকল্পনার রূপরেখা আজও উপস্থাপন করেনি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত আট মাসে ৫৪,৩০০-র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১,২৪,০০০ জন।

জাতিসঙ্ঘের হিসাবে, গাজা বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত অঞ্চল, যেখানে সম্পূর্ণ জনসংখ্যাই দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। ইসরাইল ২ মার্চ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত পুরোপুরি মানবিক সাহায্য বন্ধ রেখেছে এবং গাজার ৭০ শতাংশ এলাকা নিষিদ্ধ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে।

এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অনেক বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন, যুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য হামাসের পরাজয় নয়। বরং গাজার সাধারণ জনগণের উপর জাতিগত নিধনের কৌশল প্রয়োগ।

হিব্রু ভাষার সংবাদমাধ্যম লোকাল কল-এর সম্পাদক মেরন র‍্যাপাপোর্ট বলেন, হামাস কিংবা বন্দীরা আসলে ইসরাইলের লক্ষ্য নয়। আসল লক্ষ্য হলো গাজার জনগণকে এমন ছোট, ঘনবসতিপূর্ণ ও অবরুদ্ধ এলাকায় ঠেলে দেয়া, যেখানে খাবার সরবরাহ খুব সীমিত থাকবে। এই আশায় যে অবশেষে তারা নিজেরাই এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।

তিনি যোগ করেন, ইসরাইল আর হামাসের সাথে যুদ্ধ করছে না।

মে মাসের শেষদিকে নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন যে গাজায় সামরিক অভিযান শেষ হলে ইসরাইল অঞ্চলটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের পরিকল্পনা আসলে গাজার জনগণের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ এবং নিয়ন্ত্রিত জাতিগত নির্মূলের পথ সুগম করে।

ইসরাইলি দৈনিক হারেৎজ-এ প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ ইহুদি ইসরাইলি গাজাবাসীদের উচ্ছেদের পক্ষে মত দিয়েছেন।

ডায়ানা বুট্টু মন্তব্য করেন, নেতানিয়াহু এই বিশ্বাস পোষণ করেন যে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের মাধ্যমে তিনি ইসরাইলকে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র থেকে রক্ষা করছেন।

বুট্টু বলেন, নেতানিয়াহুর কাছে এটি একটি দ্বিমুখী বাজি। হয় তিনি পতনের প্রতীক হবেন, অথবা নায়ক হয়ে উঠবেন। যদি তিনি গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে পারেন, তবে তিনি নিজেকে ইতিহাসের নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন।

ফলে হামাসের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব, বন্দিমুক্তি কিংবা শাসনত্যাগ, কোনো কিছুকেই ইসরাইলি নেতৃত্ব আমলে নিচ্ছে না।

মাইরাভ জোনসেইন বলেন, নেতানিয়াহুর এই যুদ্ধ শেষ করার কোনো সদিচ্ছা নেই। হামাস কী প্রস্তাব দিচ্ছে তাতে তার কিছু যায় আসে না। তারা যদি সব বন্দীদের ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাবও দেয় কিংবা শাসন ছেড়ে দেয়ার কথা বলে। তবু যুদ্ধ চলবে।

এই যুদ্ধ কেবল তখনই শেষ হবে, যখন নেতানিয়াহু বাধ্য হবেন তা বন্ধ করতে এবং সেই চাপ কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকেই আসতে পারে।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top