মুফতি এনায়েতুল্লাহ
২০১৩ সাল থেকে হেফাজতের আন্দোলনে শামিল হয়ে এ দেশের অযুত জনতা তাদের ঐতিহ্য, আদর্শ আর বিশ্বাসের জানান দিয়ে আসছে। হেফাজতের কর্মী সমর্থক নির্দিষ্ট কোনো দলের নয়, এদেশের ধর্মপ্রাণ আবাল বৃদ্ধ যুবক জনতাই তাদের নেতাকর্মী-সমর্থক। ধর্মীয় বিশ্বাসে বলীয়ান এ জনপদের মানুষের আদর্শ বিশ্বাস ও চেতনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হিসেবে হেফাজতের আবির্ভাব। একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের এমন উত্থান নিকট অতীতকালে আর এমন নজির নেই। ক্ষমতা, পদ-পদবী ও লোভনীয় কোনো কিছুর বিনিময়ে মানুষ হেফাজতের ডাকে সাড়া দেয়নি। হৃদয় কোণে লালিত আদর্শ, বিশ্বাস ও ভালোবাসার টানেই জনতা হেফাজতের আন্দোলনের প্রতি সাড়া দিয়েছিল।
একটু চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা পুনরায় আঁকার কিংবা মনে করার চেষ্টা করুন। আন্দোলনের দিনগুলোতে শহরবাসীর হৃদয় উজাড় করা আপ্যায়ন। কারো হাতে পানির বোতল, কারো হাতে টিস্যু পেপার, কারো হাতে শরবতের গ্লাস, কেউ আপ্যায়িত করছেন শসা, তরমুজ, কলা দিয়ে। কেউবা বাসা থেকে তৈরি করে এনেছেন রুটি, অনেকেই দোকান থেকে কিনে এনেছেন পাউরুটি বিস্কুট, যে যেভাবে পারছেন আগত মানুষগুলোকে আপ্যায়ন করানোর চেষ্টা করেছেন। কে কার আগে আপ্যায়ন করাবেন তার প্রতিযোগিতা চলেছে।
এর পরের ইতিহাস বেদনার, কষ্টের ও রক্ত ঝরানোর। হেফাজতের সমাবেশের ম্যাচাকার- ইতিহাসের পাতায় জঘন্য গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানির এক দশক সহজে ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এক কথায়, ফ্যাসিবাদের বিপরীতে হেফাজতের উত্থানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সঙ্গত কারণেই, লম্বা ফিরিস্তি টানার দরকার নেই। ফ্যাসিবাদের পতনের পর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে হেফাজতে ইসলামকে একটি শক্তিশালী ও কার্যকার প্রেশার গ্রুপে পরিণত করার। যেহেতু হেফাজতের নেতৃত্বে প্রায় সব দলের নেতারাই রয়েছেন। হেফাজতের উত্থাপিত ১৩ দফার বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক বিষয়ের বাইরে ইসলামি দলগুলো ঐক্য প্রতিষ্ঠাসহ ধর্মীয় স্বকীয়তা বিষয়ক দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে হেফাজতকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে হেফাজত হতে পারে একটি আদর্শ ও শক্তিমান প্রেশার গ্রুপ।
আমরা জানি, রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরণের প্রেশার গ্রুপ থাকে। প্রেশার গ্রুপ হলো, এমন একটি সংগঠন বা গোষ্ঠী, যা সরকার ও নীতিনির্ধারকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে। তারা কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং নির্দিষ্ট ইস্যুতে প্রভাব বিস্তারকারী গোষ্ঠী। যারা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি-গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে। প্রেশার গ্রুপ বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে প্রভাবিত করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করে। যেমন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, জনসচেতনতা সৃষ্টি, লবিং, বিক্ষোভ, প্রচার অভিযান, অনলাইন সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি, আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।
প্রেশার গ্রুপের বিকশিত রুপ হলো- নানা শ্রমিক সংগঠন, পেশাজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন নাগরিক কমিটি, নারীবাদী আন্দোলন, মানবাধিকার সংগঠন ও পরিবেশবাদী গোষ্ঠী ইত্যাদি। প্রেশার গ্রুপ সাধারণত সাংগঠনিক ও কৌশলগত উপায়ে সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। জনমত গঠনে কাজ করে। যখন সাধারণ জনগণের মধ্যে কোনো বিষয়ে অসন্তোষ থাকে এবং প্রেশার গ্রুপ সেই ক্ষোভকে সংগঠিত করে।
উন্নত বিশ্বে প্রেশার গ্রুপগুলো সাধারণত স্বাধীন সংগঠন হিসেবে কাজ করে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত থাকে। প্রেশার গ্রুপের কাজ হলো, জনগণের কণ্ঠস্বরকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরা। সরকার, সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানকে জনগণের স্বার্থ রক্ষায় জবাবদিহিতার আওতায় আনা। বিষয় বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন পক্ষ, দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কাঙ্খিত ম্যাসেজ প্রদান এবং তাদের চাহিদা অনুধাবণ করা।
যেহেতু সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নির্দিষ্ট শ্রেণি-গোষ্ঠীর স্বার্থকে উপেক্ষা করে বিশেষ স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই প্রেশার গ্রুপের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এমতাবস্থায় হেফাজতে ইসলাম হতে পারে একটি কার্যকর প্রেশার গ্রুপ। যারা ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থে কাজ করবে।
পরিবেশ এখন অনুকূলে, সেহেতু বিষয়গুলো নিয়ে নেতাদের ভাবা দরকার। মনে রাখতে হবে, হেফাজতে ইসলামের ১৩টি দাবি প্রতিটি ঈমানদার মুসলমানের প্রাণের দাবি, দেশপ্রেমিক জনগণের দাবি। কোনো ঈমানদার মুসলমান জেনে বুঝে এ দাবিগুলোর বিরোধিতা করতে পারে না।
আশা করি নেতৃবৃন্দ, হৃদয়ে আল্লাহর ভালোবাসা এবং তার প্রতি ভয় এবং হুব্বে রাসূলের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে, উম্মাহর প্রতি থাকা দায়বোধ থেকে বিবেকের তাড়নায় যথার্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। মৃত্যুর ভয় ও পরকালের হিসাবের কথা ভেবে কর্মপন্থা নির্ধারণে ভূমিকা রাখবেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের সহায় হোন।
লেখকের ফেসবুক থেকে