পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে
চট্টগ্রামে ইমরান এইচ সরকারকে বাধাদান
ইমরান এইচ সরকার বিভিন্ন এলাকায় গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশ করে চলেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৩ মার্চ চট্টগ্রামে সমাবেশের ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণার পর হেফাজত চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের যেকোনো সমাবেশকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে হেফাজত।
১১ মার্চ ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন হলে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে সংগঠনের তৎকালীন মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. উপস্থিত ছিলেন। হেফাজতের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়। বক্তব্য পাঠ করেন হেফাজতের তৎকালীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাইনুদ্দিন রুহি। লিখিত বক্তব্যে হেফাজতের আন্দোলনের উদ্দেশ্য উল্লেখ করে বলা হয়, ‘আমাদের আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়। বরং যারা নবীজি সা.কে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ করছে, আমাদের আন্দোলন তাদের বিরুদ্ধে।’
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, ‘ইমরান এইচ সরকারকে চট্টগ্রামে আসতে দেয়া হবে না। সে এলে আমরা যেকোনো উপায়ে প্রতিহত করব।’ এ সময় হেফাজত আহ্বান জানায়, দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে যেন ১৩ মার্চ শাহবাগীদের চট্টগ্রাম কর্মসূচিকে বাধা দান করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজত সেদিন সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা করে। পরে তারা এও ঘোষণা দেয় যে যেখানে শাহবাগী নাস্তিক পাওয়া যাবে, সেখানেই কাপনের কাপড়ে প্রতিরোধ করা হবে। (নয়া দিগন্ত, ১২ মার্চ ২০১৩)।
এই ব্রিফিংয়ের পর চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের অফিসে ডাক পড়ে আলেমদের। হেফাজতের ছয়-সাতজন প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত হন। তখন চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার ছিলেন ডিআইজি শহিদুল হক। তিনি বলেন, ‘ইমরান এইচ সরকার এ দেশের নাগরিক। এই দেশের সব জায়গায় যাওয়ার তার অধিকার আছে। আপনি বাধা দিতে পারেন না।’
মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বললেন, ‘দেশের নাগরিককে বাধা দিচ্ছি না। বাধা দিচ্ছি আল্লাহর নবির দুশমনকে। তবুও যদি সে আসে, মদিনা থেকে ডেকে আল্লাহর নবিকে নিয়ে আসব। তিনি এসে তার ইজ্জত তিনিই রক্ষা করবেন।’
হেফাজতের এই অনড় অবস্থানের কারণে প্রশাসন সমগ্র চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভেতর ১৪৪ ধারা জারি করে। তবে প্রশাসনের এই কারফিউকে চ্যালেঞ্জ করে ইমরান চট্টগ্রামের পথে রওনা দেন। পরে ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম আসার পথে দুই গাড়ি অস্ত্রসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। (যুগান্তর ও প্রথম আলো, ১৪ মার্চ ২০১৩)
হেফাজতে ইসলাম কেন গঠন করতে হলো (১ম পর্ব)
হেফাজতে ইসলাম কেন গঠন করতে হলো (পর্ব-২)
হেফাজতে ইসলাম কেন গঠন করতে হলো (পর্ব-৩)
হেফাজত-চরমোনাই বিতর্ক
৯ মার্চ হাটহাজারি মাদরাসায় অনুষ্ঠিত হয় হেফাজতে ইসলামের ওলামা সম্মেলন। এ সম্মেলনেই ৬ এপ্রিল পুরো দেশ থেকে ঢাকামুখী লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ সম্মেলন থেকেই হেফাজত-চরমোনাই বিতর্ক শুরু।
মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘ওলামা সম্মেলনে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে চরমোনাই পীর মুফতি রেজাউল করিম একটু অসংযত এবং অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেন। ফলে সম্মেলনে শোরগোল শুরু হয়। এমনকি এই শোরগোল হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যায়। তখন আল্লামা আহমদ শফির নির্দেশেই মাইক বন্ধ করে দেয়া হয়।’
তবে ইউটিউবে প্রকাশিত ওলামা সম্মেলনের ভিডিওতে দেখা যায়, চরমোনাই পীর সাহেবের বয়ানের সময় কোনো অযাচিত শোরগোল ঘটেনি। বরং মুফতি রেজাউল করিম আল্লামা আহমদ শফি সাহেব যে কর্মসূচি দিবেন, তা সবাইকে মেনে নেয়ারও আহ্বান জানান।
মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘এরপর চরমোনাই পীর কার্যত হেফাজতে ইসলামের বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে যান। আল্লামা আহমদ শফি এক ধরণের বিবৃতি দেন, তিনি দেন আরেক ধরণের। সর্বশেষ তিনি হেফাজতের লংমার্চের বিপরীতে ৬ এপ্রিল কুয়াকাটামুখী লংমার্চের ডাক দেন। ৬ এপ্রিল হেফাজত ঘোষণা করেছে ঢাকামুখী লংমার্চ, আর চরমোনাই পীর ঘোষণা করেছেন কুয়াকাটামুখী লংমার্চ। এমন সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়েও আল্লামা আহমদ শফি চাইছিলেন, তবুও যেন হেফাজতের সঙ্গে চরমোনাই পীর থাকেন। এ উদ্দেশ্যেই ৫ এপ্রিল, লংমার্চের আগের দিন মাগরিবের পর, ইসলামি আন্দোলনের অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমাদসহ চারজনের সঙ্গে লালবাগে একটি বৈঠক হয়। হেফাজতের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন—মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমি, মাওলানা মাহফুজুল হকসহ আরও কয়েকজন।
বৈঠকে চরমোনাই পীরকে চারটি শর্ত দেয়া হয়। তারমধ্যে অন্যতম তিনটি হলো—১. হেফাজতের বিবৃতির বিপরীত বিবৃতি না দেয়া। ২. আগামিকাল দৈনিক পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে হেফাজতের সঙ্গে সমর্থন ব্যক্ত করা। ৩. কুয়াকাটামুখী লংমার্চ বাতিল করা। কিন্তু শর্তগুলোর একটিও পালন করেননি তিনি। তাই লংমার্চের মঞ্চে দাঁড়িয়ে জুনায়েদ আল হাবিব ঘোষণা করেছিলেন, ‘আপনি শর্ত মানেননি। আপনাকে স্টেজে আসতে দেয়া হবে না।’
এই জায়গায় একটা নোট যুক্ত করতে হয়। ২৯ মার্চ, ২০১৩ ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় মহাসমাবেশে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন চরমোনাই পীর—তা বলছে অন্যকথা। কর্মসূচি লিখিত লিফলেটে দেখা যায়—তিনি সর্বপ্রথম ৬ তারিখে হেফাজতের লংমার্চে সমর্থন জানানোর কথা বলেছেন। এদিন অন্যকোনো কর্মসূচি রাখেননি। তারপর ১৯, ২০ এবং ২১ এপ্রিল লংমার্চ নয়, বরং কুয়াকাটার অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ৮ এবং ৯ মে ঘোষণা করেছেন মায়ানমার অভিমুখে লংমার্চ।
যেভাবে হেফাজতের আবির্ভাব (পর্ব-৪)
হেফাজতে ইসলামের প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি (পর্ব-৫)
ইনোসেন্স অফ মুসলিমস ও হেফাজতের হুব্বে রাসূল সমাবেশ (পর্ব-৬)
হেফাজতে ইসলামের নৈতিক বৈধতা
নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার পর সুশীল মিডিয়াগুলো বরাবরই চেয়েছে হেফাজতে ইসলামের নৈতিক বৈধতা ধ্বসিয়ে দিতে। একযোগে তারা প্রচার করেছে—যুদ্ধাপরাধের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলন দমাতেই হেফাজতে ইসলামের নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন শুরু। শাহবাগ আন্দোলনের লিডিং রুলে যারা, তারা নাস্তিক নয়। এমনকি ব্লগার আরিফ জেবতিক বলেছিল, ‘ব্যক্তগতভাবে কেউ যদি নস্তিক হয়েও থাকে, তার দায় এই আন্দোলনের ওপর পড়বে না। শাহবাগের আন্দোলন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আন্দোলন।’ (একাত্তর টিভি)
প্রখ্যাত আলেম এবং লেখক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে—হেফাজতে ইসলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শাহবাগের আন্দোলন থামাতে মাঠে আসেনি। বরং এই আন্দোলন থেকে ক্রমাগত যখন ইসলামকে আক্রমণ করা হয়েছে, টুপি-দাড়িকে অপমান করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছে হেফাজত। আন্দোলনের লিডিং রুলে থাকা কেউ ব্যক্তিগতভাবে নাস্তিক হলে তার দায় শাহবাগ আন্দোলনের নেতারা নিবেন না, তা বলে পার পাওয়া যাবে না। কারণ, তারা বারবার প্রমাণ করেছে, তারা নাস্তিকদের পক্ষে। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কিছু বলা হলেই শাহবাগ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। নাস্তিকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পত্রিকায় বিবৃতিও দিয়েছে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে—তর্কের খাতিরে যদিও ধরা হয় শাহবাগের আন্দোলন থামাতেই হেফাজত মাঠে নেমেছে, তবুও হেফাজতের আন্দোলন বৈধ। কারণ, শাহবাগের আন্দোলনের জন্মই হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে অসম্মান করে। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
আবদুল কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়ানো কিংবা কমানো নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। আমি শুধু বলছি—এমন তো নয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছিল না। বিচার না হলে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো কিভাবে? সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন—এটা একটা ফাঁপা বুলি ছিল। মানুষকে বিভ্রান্ত করার ভেলকিবাজি ছিল। যারা আদালতকে অসম্মান করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছে, তাদের দমাতে হেফাজত আন্দোলন করে থাকলেও হেফাজতের আন্দোলন বৈধ। হেফাজত মূলত রাষ্ট্রের পক্ষে, আদালতের পক্ষে লড়াই করেছে।’
চলবে…
গণজাগরণ মঞ্চ : যেভাবে শুরু হয় শাহবাগ আন্দেলন (পর্ব-৭)
ভয়ঙ্কর ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারচক্র (পর্ব-৮)
নাস্তিকদের উত্থান ঠেকাতে হেফাজতের পদক্ষেপ (পর্ব-৯)