শায়খ ইবনুল কালাম
স্বাভাবিক অবস্থায় ইসলাম পণ্যমূল্য নির্ধারণকে সমর্থন করে না। বরং ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ক্রেতা ও বিক্রেতা পারস্পরিক দাম-দরের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করবে। কারণ, মূল্য হলো বিক্রেতার অধিকার। তার অধিকার সেই নির্ধারণ করা উচিৎ। অন্যজনের হস্তক্ষেপ এক্ষেত্রে কাম্য নয়, স্বাধীনতা নষ্ট করে। কুরআন শরিফে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। তবে যদি পারস্পরিক সন্তুষ্টচিত্তে হয়, তবে খেতে পারো। (সূরা নিসা, আয়াত : ২৯) অপরদিকে হাদিসে এসেছে, একবার নবীজির যুগে বাজারের দাম-দর বেড়ে গিয়েছিল। তখন সাহাবীরা এসে নবীজি সা.-কে বলেছেন যে হে আল্লাহর রাসূল, বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে গেছে। আপনি তা নিয়ন্ত্রণ করুন। আল্লাহর রাসূল সা. রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালাই বাজারে দ্রব্যমূল্যের গতি নির্ধারণ করে থাকেন। তিনিই তা বৃদ্ধি করেন এবং তিনিই তা সংকুচিত করেন। তিনিই সবাইকে রিজিক দান করেন।’ এরপর রাসূল সা. বলেন, আমি আল্লাহ তায়ালার সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে চাই, যেন আমার বিরুদ্ধে তোমাদের কেউ প্রাণ বা সম্পদের ব্যাপারে জুলুমের অভিযোগ উত্থাপন না করতে পারো। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৫১
তবে কোথাও যদি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য আদায় করে থাকে, প্রসাশনের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্য রাখার তাগিদ দেয়ার পরও ব্যবসায়ীরা তা মান্য না করে, তাহলে সরকার ক্রেতা সাধারণের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই বাজার ও ভোক্তা খাতের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে।
‘অস্বাভাবিক মূল্য’ এটি ফিকাহ শাস্ত্রের একটি পরিভাষা। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো পণ্যের এমন দাম, বাজার ও ভোক্তা খাতের বিশেষজ্ঞরা যেটাকে বেশি মনে করে। তবে সাধারণ মানুষের বুঝার সুবিধার্তে ফুকাহায়ে কেরাম এর একটি ধারণা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এই মূল্যটি পণ্য হিসেবে কম বেশি হতে পারে। যেমন স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে তার বাজার দরের এক পঞ্চমাংশ বেশি হলে তা অস্বাভাবিক মূল্য গণ্য হবে। প্রাণীর ক্ষেত্রে বাজার মূল্যের চেয়ে এক দশমাংশ বেশি হলে সেটি অস্বাভাবিক দাম ধরা হবে। আরজের ক্ষেত্রে অর্ধেক দাম বেশি হলে অস্বাভাবিক মূল্য ধরা হবে। এই হিসাব অনুযায়ী যদি ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে চায়, তাহলে সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ নিতে পারেন। আর পণ্যমূল্য যদি সহনীয় পর্যায়ে থাকে, তাহলে মূল্য নির্ধারণের প্রয়োজন নেই।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আরো কিছু কারণ ফিকাহ শাস্ত্রে চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো হলো, মজুদদারি, কালোবাজারি, মধ্যস্বত্বভোগী ও কৃষির প্রতি অমনোযোগ। এসব সঙ্কট নিরসনে ইসলাম প্রধানত আখেরাতের ভয়ের মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছে। যেমন আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখে, আল্লাহ তার উপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫৫)।
অন্য হাদিসে বলেন, যে ব্যক্তি নিজের ঘরে ৪০ দিনের খাবার মজুদ করে রাখে, সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ২০৩৯৬)।
এক হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করতাম। নবী করিম (সা.) খাদ্যের বাজারে পৌঁছানোর আগে আমাদের তা ক্রয় করতে নিষেধ করলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২১৬৬)।
আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী দলের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের থেকে খাদ্য ক্রয় করতাম। নবী করিম (সা.) খাদ্যের বাজারে পৌঁছানোর আগে আমাদের তা ক্রয় করতে নিষেধ করলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২১৬৬)
দ্বিতীয় করণীয় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে বয়কটকে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের অন্যায় মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাজ বর্ধিত মূল্যের পণ্য বর্জন করবে। যেমন হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. -এর যুগে গোশতের মূল্য বৃদ্ধি পেলে লোকেরা তার কাছে অভিযোগ করে মূল্য নির্ধারণের দাবি জানায়। তখন তিনি বললেন, তোমরাই এর মূল্য হ্রাস করে দাও। তাদের কাছ থেকে গোশত কেনা ছেড়ে দাও। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৯/১৪১)
এতেও যদি কোনো ধরনের কাজ না হয়, তাহলে সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। যেমনটি ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই যে সরকার সব ধরনের জিনিসের মূল্য নির্ধারণ করবে না। বরং নিত্য প্রয়োজনীয় যেসব খাদ্যদ্রব্য রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকার কেবল নির্ধারণ করবে।
সরকার যদি পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে তা শরিয়ত ও রাষ্ট্র উভয় দিক থেকে মান্য করা আবশ্যক। অবশ্যক কেউ যদি বেশি দামে বিক্রি করে, তাহলে তার চুক্তিটি সঠিক হয়ে যাবে। ওই অতিরিক্ত মূল্যটাকেও বিক্রেতার জন্য হারাম বলা যাবে না।
তবে এক্ষেত্রে সরকার বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত ফকিহ মুফতি আবুল হাসান আব্দুল্লাহ সাহেবের প্রস্তাবনা প্রসঙ্গিক হবে। তাই তার বয়ানেই প্রস্তাবনাটি তুলে ধরছি।
মুফতি আবুল হাসান আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সুষ্ঠু পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের লোকদের আর্থিক অবস্থা ও পরিবারের কর্তা ব্যক্তির আয়ের পরিমাণ এবং তার উপর নির্ভরশীল লোকজনের সংখ্যা উল্লেখ করে একটি ডাটা তৈরি করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ কাজ করানো যেতে পারে, যা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকদের মাধ্যমে নিরীক্ষিত হয়ে চূড়ান্ত করা হবে। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।
এরপর যে সকল পরিবারের কর্তা ব্যক্তির আয় তাদের অতিজরুরি খাদ্য, পানীয় ও পুষ্টির জোগাড়ের জন্য যথেষ্ট নয়, তাদেরকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের আয় দ্বারা কত টাকা মূল্যে তারা চাল, ডাল, আটা, তেল ও শিশুখাদ্য ক্রয়ে সক্ষম সে হিসাব লাগিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি রেশন কার্ড চালু করতে হবে এবং সামর্থ অনুযায়ী কার্ডধারীদেরকে ১০ থেকে ১৫ বা ২০ অথবা এ ধরনের যে মূল্যে তারা চাল, আটা খরিদে সক্ষম, সে মূল্যে তাদেরকে তা সরবরাহ করতে হবে। এমনিভাবে ডাল, তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও নিয়ন্ত্রিত মূল্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরবরাহ করতে হবে। আর যারা একেবারেই আয়হীন তাদের জন্য চালু করতে হবে প্রয়োজন অনুপাতে সরকারি রিলিফ।’ (সূত্র : আল কাউসার : সফর : ১৪২৯ হিজরী মোতাবেক ফেব্রুয়ারি ২০০৮)
এই প্রস্তাবনা আমলে নেয়া গেলে খুব সহজেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব।
শেষ কথা হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার শাস্তি। তাই দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে পাপ পরিহার করা এবং তাওবা করে ফিরে আসা আবশ্যক। আল্লাহ সবাইকে পার্থিব জীবনের এই সংকট থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক