তুরস্কসমর্থিত সোমালিয়া ইথিওপিয়া চুক্তির নেপথ্য কূটনীতি ও ভূরাজনীতি

তুরস্কের কৌশলী ভূমিকায় আঙ্কারায় সাক্ষাতে সোমালিয়া ইথিওপিয়া চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এতে সোমালিল্যান্ড সঙ্কট, সোমালিয়া আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সমুদ্র বন্দর প্রবেশাধিকার নিয়ে গড়ে উঠেছে আঙ্কারা ঘোষণা। এর মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলা উত্তেজনার লাগাম টেনে ধরার বিষয়ে অগ্রগতির আশা করা হচ্ছে।

বুধবার আঙ্কারায় তুরস্কের মধ্যস্থতায় সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মোহাম্মদ এবং ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠকে ওই চুক্তি সম্পন্ন হয়।

মার্কিন চাপে সোমালিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত

সোমালিয়া ইথিওপিয়া চুক্তি কিভাবে হয়

তুরস্ক প্রায় এক বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে চলমান সমুদ্রবন্দর ইস্যুতে সমাধান আনার চেষ্টা করছিল। তবে এতদিন পর্যন্ত ফল আসেনি—ছিল শুধু সদিচ্ছার অস্পষ্ট বিবৃতি। পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলে জানুয়ারিতে ইথিওপিয়া ও সোমালিল্যান্ডের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারক (MoU), যার মাধ্যমে ইথিওপিয়া ৫০ বছরের জন্য সোমালিল্যান্ড উপকূল ব্যবহার করে বন্দর সুবিধা পাওয়ার চুক্তি করেছিল।

সোমালিয়া একে তার আঞ্চলিক অখণ্ডতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখেছে। তারা এই সমঝোতা স্মারক বাতিলের দাবিতে কড়া অবস্থান নিয়েছে এবং প্রয়োজনে যুদ্ধের হুমকিও দিয়েছে। ইথিওপিয়া পাল্টা যুক্তি দিয়েছে, একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে তাদের সমুদ্রপথে প্রবেশাধিকার পাওয়ার অধিকার আছে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, আলোচনার সময় তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন: *”তোমরা একটি সমঝোতায় না পৌঁছানো পর্যন্ত এই ঘর ছেড়ে যাবে না।”*

এরদোয়ান ২০১১ সাল থেকে সোমালিয়ায় বিনিয়োগ করছেন। সেখানে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি, হাজার হাজার সৈন্য প্রশিক্ষণ, বিমানবন্দর ও বন্দর পরিচালনা এবং মানবিক সহায়তা সবই এর অংশ। একইভাবে, ২০২১ সালে আবি আহমেদকে ড্রোন সরবরাহের মাধ্যমে টাইগ্রে যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল তুরস্ক।

সোমালিয়ায় ইসরাইলি রাডার মোতায়েন সংযুক্ত আরব আমিরাতের

আলোচনার কেন্দ্রে আঞ্চলিক অখণ্ডতা

তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান এবং এরদোয়ান সরাসরি আলোচনায় যুক্ত ছিলেন। প্রায় সাত ঘণ্টার এই দীর্ঘ আলোচনায় মূল বিষয় ছিল—ইথিওপিয়া কি সোমালিয়ার আঞ্চলিক ঐক্যকে স্বীকৃতি দেবে?

সূত্র জানায়, আবি আহমেদ সাধারণভাবে সোমালিয়ার সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হলেও, “আঞ্চলিক অখণ্ডতা” শব্দটি ব্যবহারে আপত্তি জানান। জবাবে সোমালি প্রতিনিধিরা ১৯৩৩ সালের মন্টেভিডিও কনভেনশনের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে রাষ্ট্রের জন্য একটি *”সংজ্ঞায়িত অঞ্চল”* থাকা আবশ্যক বলে উল্লেখ আছে।

তুর্কি কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত এই যুক্তিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন এবং স্পষ্ট করেন—ইথিওপিয়া বা তো সম্পূর্ণ স্বীকৃতি দেবে, নয়তো কিছুই নয়।

আঙ্কারা ঘোষণা : সমঝোতার পথ

ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনার পর উভয় দেশ “আঙ্কারা ঘোষণা” নামে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। এই ঘোষণায় ইথিওপিয়া সোমালিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে স্বীকৃতি দেয়, অন্যদিকে সোমালিয়া ইথিওপিয়াকে উপকূলীয় বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার দিতে সম্মত হয়।

তুরস্কের সহায়তায় দুই দেশের প্রযুক্তিগত দল ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আলোচনা শুরু করবে, যার সময়সীমা নির্ধারিত চার মাস।

কৌশলগত সুবিধা কার?

তুর্কি বিশেষজ্ঞ এবুজার ডেমিরসি মনে করেন, সোমালিয়া একাধিকভাবে লাভবান হয়েছে। এর আগে তুরস্কের সঙ্গে জলসীমা রক্ষা ও নৌবাহিনী গঠনের একটি চুক্তিও করেছে তারা। সোমালিয়া সফলভাবে সোমালিল্যান্ড ইস্যুকে একটি কূটনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার করেছে।

আবির পক্ষেও কিছু লাভ হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট উস্কে দিয়ে তিনি বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে আনতে সক্ষম হন এবং শেষমেশ উপকূলীয় প্রবেশাধিকার আদায় করে নেন।

আন্তর্জাতিক চাপ এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ইঙ্গিত

দ্য ইকোনমিস্টের আফ্রিকা সংবাদদাতা টম গার্ডনার জানিয়েছেন, আবির উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল কূটনৈতিক চাপ ছিল। সোমালিয়ায় আল-শাবাবের মতো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও শান্তিরক্ষায় ইথিওপিয়ার অবদান মার্কিন প্রশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে, নতুন নির্বাচিত সোমালিল্যান্ড প্রেসিডেন্ট আবদিরহমান মোহাম্মদ আবদুল্লাহির সঙ্গে আবির সম্পর্ক পূর্বসূরীর তুলনায় অনেক দুর্বল। সেমাফোর-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসন সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

চুক্তিটি একটি আপাত বিজয় হিসেবে দেখা গেলেও, এটা পরিষ্কার যে গভীর কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সমীকরণ এখনো খেলছে। সোমালিয়া তার আঞ্চলিক অখণ্ডতা সুরক্ষিত করেছে, আর ইথিওপিয়া পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত উপকূলীয় প্রবেশাধিকার—সবই তুরস্কের কৌশলী নেতৃত্বে।

উল্লেখ্য, মার্কিন সামরিক বাহিনীর তদবিরের সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মোহাম্মদ রোববার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবদুল কাদির মোহাম্মদ নূরকে বরখাস্ত করেছেন।

সূত্রমতে, মার্কিন সহায়তা ধীর হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতের পরিপ্রেক্ষিতে সোমালিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করে বন্দরমন্ত্রী হিসেবে পুনর্নিযুক্ত করা হয়েছে।

পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত দু’টি সূত্র মিডল ইস্ট মনিটর-কে জানায়, নূরের নেতৃত্বে তুরস্কের সাথে সামরিক, জ্বালানি এবং মহাকাশ খাতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার চেষ্টা ওয়াশিংটনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন প্রশাসন আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি সোমালিয়া-তুরস্ক সম্পর্কের বিস্তারকে সন্দেহের চোখে দেখছে।

নূরের নেতৃত্বে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়া ও তুরস্ক একটি বিস্তৃত নৌ, বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। যদিও চুক্তির পুরো বিবরণ গোপন রাখা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এতে তুরস্ককে সোমালির জলসীমা রক্ষা, একটি জাতীয় নৌবাহিনী গঠন এবং জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানে সহায়তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপটি ইথিওপিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্ন অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের সাথে সাম্প্রতিক নৌচুক্তির জবাব হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে।

আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও সাবলীল তুর্কি ভাষাভাষী আবদুল কাদির মোহাম্মদ নূর দীর্ঘদিন ধরে তুর্কি নেতৃত্বের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top