আসিফ আদনান
“যারাই গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে তারা বিপথগামী/পথভ্রষ্ট/উগ্র” – জাতীয় অবস্থানের সমস্যা
.
১। কোন কিছু নরম্যাটিভিটি যাচাই করার, হক-বাতিল নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড এবং পদ্ধতি ইসলামে আছে।
.
কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে হিদায়াতপ্রাপ্ত বা গোমরাহ বলতে হলে তাদের বিশ্বাস (আকীদাহ), মূলনীতি (উসুল) এবং পদ্ধতিকে (মানহাজ ও ফিকির) কুরআন-সুন্নাহ এবং আহলুসসুন্নাহ-র মানদণ্ডে যাচাই করতে হয়। নিজের খেয়ালখুশিমতো কিছু একটা বলে দিলেই হয়ে যায় না। পশ্চিমা রাজনৈতিক তত্ত্ব দিয়ে মাপলেও হয় না।
.
গণতন্ত্র একটা পশ্চিমা মানবরচিত মতবাদ এবং ব্যবস্থা। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, আধুনিক রিপাবলিকের ধারণা, জাতিরাষ্ট্র, মানবাধিকার কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতার আধুনিক ধারণা থেকে শুরু করে যতো তন্ত্র-মন্ত্র আছে, সবই পশ্চিমা ইতিহাস ও দর্শনের ভেতরে জন্ম নেয়া মানবরচিত মতবাদ এবং ব্যবস্থা। এগুলো গ্রহণ না করলে কেউ বিপথগামী – এমন কথার কোন ইসলামী বৈধতা নেই।
.
বরং কোন মুসলিম গণতন্ত্র গ্রহণ করলে সে সঠিক পথে আছে, আর গণতন্ত্রের বিরোধিতা করলে সে ভুল পথে আছে, এটা সত্যের লিটারেল ইনভারশান।
.
বাস্তবতা হলো, যারা সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে, তাদেরকেই উল্টো করে প্রমাণ করতে হবে যে তারা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক মতবাদ, ব্যবস্থা ও পদ্ধতি গ্রহণ করেনি, তারা ইমান ও তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক কোন কাজ করছে না, শরীয়াহর সীমানার বাইরে কোন কাজ করছে না।
.
.
২। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ সহ অনেক পূর্ববর্তী আলেম বলেছেন, আহলুল বিদআহ বা বিদআতিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তারা দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু মূলনীতি, কনসেপ্ট বা স্লোগান আমদানী করে। তারপর সেগুলোকে হক ও বাতিল, হিদায়াত ও গোমরাহি, বন্ধুত্ব ও শত্রুতার মাপকাঠি বানায়।
.
মু’তাযিলারা গ্রিক দর্শনের ভিত্তিতে মহান আল্লাহর যাত ও সিফাতের ব্যাপারে ভুল উপসংহারে পৌছেছিল। তারপর সেই ভুল উপসংহারকে (যেমন খালকে কুরআনের ব্যাপারে তাদের ভুল অবস্থান) আকীদাহর স্ট্যান্ডার্ড বানিয়ে নিয়েছিল। যারা বিরোধিতা করেছিল, অর্থাৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামআহ, তাদের অত্যাচার করেছিল।
.
আজ যারা গণতন্ত্র গ্রহণকে হক হবার শর্ত বানাচ্ছে এবং গণতন্ত্র না মানাকে গোমরাহি বা ‘উগ্রতার’ প্রমাণ বানাচ্ছে, তারা আহলুল বিদআহর মৌলিক বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করছে, এমন বলা যেতে পারে। গণতন্ত্রকে যেহেতু তারা মানদণ্ড বানাচ্ছে, তাই বর্ণনামূলক বিশেষণ হিসেবে তাদের ‘গণতন্ত্রী’ বলাটা যৌক্তিক হতে পারে।
.
.
৩। ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্রকে ‘হক হবার মানদণ্ড’ বানাবার সুযোগ নেই। গণতন্ত্র না মানলে কেউ উগ্র বা বিপথগামী এমন বলার ইলমী ভিত্তি নেই কোন। তবে অ্যামেরিকার সিকিউরিটি ডিসকোর্স অনুযায়ী এই কথা ঠিক আছে।
.
পেন্টাগনের সাথে ঘনিষ্ঠ, লেজেন্ডারি থিংক ট্যাংক র্যান্ড কর্পোরেশনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী—
– মুসলিমদের মধ্যে যারা লিবারেল ডেমোক্রিসি গ্রহণ করেছে তারা মডারেট, গুড মুসলিম।
– যারা গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে খিলাফাহ, ইমারাহ, শরীয়াহর কথা বলে, তারা র্যাডিকাল বা এক্সট্রিমিস্ট মুসলিম। [১]
.
গণতন্ত্র গ্রহণ করাকে ‘হকপন্থী’ হবার বৈশিষ্ট্য বানানোকে র্যান্ড কর্পোরেশন ও অ্যামেরিকার দেয়া মানদণ্ড। যারা এই দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করেন ও কথা বলেন তাদের ‘মডারেট’ বা ‘র্যান্ড-মডারেট’ বলা যৌক্তিক। যেহেতু তারা সরাসরি মার্কিং থিংক-ট্যাংক এবং ওয়ার অন টেরর প্রকল্পের ভাসাতেই কথা বলছেন। এবং বিশেষ করে এধরণের দলের লোকেরা নিজেরাই যখন নিজেদের মডারেট বলে প্রচার করে।
.
সাইড নোট: উল্লেখ্য, রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচুর আলাপ আছে, অ্যামেরিকা জামায়াতকে সমর্থন দিচ্ছে। এ নিয়ে জামায়াতের জনৈক এমপি প্রার্থী নিজেও মাহফিলে বক্তব্য দিয়েছেন, আমেরিকা চায় বাংলাদেশে জামায়ত ক্ষমতায় আসুক। [২]
হয়তো র্যান্ডের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারার পুরস্কার হিসেবেই এই সমর্থন আসছে।
এখানে একটা যৌক্তিক প্রশ্ন আসে, আমেরিকার মন পেতে ‘মডারেট’ বা ‘গণতন্ত্রী’-রা সামনে আরও কী কী করতে প্রস্তুত?
.
.
৪। দুনিয়া জুড়ে যালিমদের বৈশিষ্ট্য হলো, যে আমার বিরুদ্ধে সে খারাপ/শত্রু/বিপথগামী; এই ধরনের ফ্রেইমিং। গণতন্ত্রীরা আজ মূলত একই ফ্রেইমিং ব্যবহার করছে। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক একটা জিনিশ গ্রহণ না করার কারণে তারা মুসলিমদের আদারিং করছে।
.
এই মানসিকতার সাথে খারেজিদের চিন্তাধারার মিল আছে। তাদের সাথে দ্বিমত করলেই মানুষ ‘গোমরাহ’ হয়ে যায়। গণতন্ত্রকে এভাবে গ্লোরিফাই করে, উসূলের পর্যায়ে তুলে নিয়ে, স্ট্যান্ডার্ড বানিয়ে ফেলা স্পষ্ট গুলু — অতিরঞ্জন ও উগ্রতার লক্ষণ।
.
.
৫। প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল, যদিও এর ফর্ম বর্তমানের চেয়ে ভিন্ন ছিল। প্লেটো, এরিস্টটলসহ গ্রিক দার্শনিকদের লেখায় বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা—রাজতন্ত্র, অ্যারিস্টোক্রেসি, ডেমোক্রেসি—নিয়ে আলোচনা আছে।
.
মুসলিম আলেমদের একটা অংশ গ্রিক দর্শন নিয়ে গবেষণা করেছেন। অর্থাৎ তারা গ্রিক রাজনৈতিক তত্ত্ব, এমনকি রোমান রিপাবলিক ও সেনেটের ধারণা সম্পর্কেও মোটামুটি ওয়াকিবহাল ছিলেন।
.
কিন্তু তারা গণতন্ত্রকে ইসলামী কোন কনসেপ্ট বা ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করেননি। কেউ বলেননি মুসলিমদের গণতন্ত্র গ্রহণ করা উচিৎ। তাদের আলোচনাতে এসেছে বাইয়াহ, খিলাফাহ, ইমারাহ, সুলতান, শূরা, আহলুল হাল্লি ওয়াল আক্বদ, সিয়াসাহ শারীয়াহ-র কথা।
.
যদি গণতন্ত্র এতই ‘ইসলামী’ হতো, তাহলে শত শত বছর ধরে উম্মাহর বড়–বড় আলিমরা কেন এটাকে ইসলামী আদর্শ হিসেবে পেশ করলেন না? তারা কি সবাই বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, আর চৌদ্দশ বছর পর এসে কয়েকজন বাংলাদেশি গণতন্ত্রীই প্রথম সত্যটা আবিষ্কার করলো?
এটাকে ঔদ্ধত্য বলবো নাকি অজ্ঞতা?
.
.
৬। প্লেটো থেকে শুরু করে হাল আমলের হান্স হারমান হপা-সহ অগণিত অমুসলিম এবং সেক্যূলার দার্শনিক, চিন্তাবিদ গণতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এরাও কি উগ্র?
.
নাকি ‘হয় গণতন্ত্র মানবি নইলে তুই জঙ্গি’ – এই ধরণের আলাপ আসলে ফলস ডিলেমা, শিশুতোষ যুক্তি, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা বা (হুসনুযযন রাখলে) বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতার পরিচায়ক?
.
.
৭। এই পুরো ঘটনায় সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হল সময়ের সাথে গণতন্ত্রী ইসলামিস্টদের অবনতির চিত্রটা। তাদের পতনের গতিপথটা একটু লক্ষ্য করুন:
.
– প্রথমে তারা গণতন্ত্রকে গ্রহণ করল শর্তসাপেক্ষে, “মন্দের ভালো” (lesser of two evils) হিসেবে।
– তারপর বলা শুরু করল, গণতন্ত্র শুধু একটা টুল / উপকরণ
– তারপর ধীরে ধীরে অবস্থান বদলে গেল: গণতন্ত্রের বিকল্প নেই
– আর এখন তারা নির্দ্বিধায় বলছে: গণতন্ত্রের বিরোধিতা করলে সে বিপথগামী/উগ্র/জং–ই।
.
.
৮। তারা যে নিজেরা বারবার ভুল করছে, এটা একটা সমস্যা। তার চেয়েও ভয়াবহ সমস্যা হল, এই ভুলগুলোকে ডিফেন্ড করার জন্য তারা ক্রমাগত দ্বীনের ভুল ব্যাখ্যা করছে। অনেক ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম, এবং আহলুস সুন্নাহর ইলমী তুরাসের ব্যাপারে বেফাঁস মন্তব্য করছে। কুরআন সুন্নাহর বক্তব্যকে জোর করে টেনে–হিঁচড়ে নিজের মতের সাথে মেলাতে চাচ্ছে।
.
তাকওয়ার দাবি হল, আমরা আমাদের খেয়ালখুশিকে মহান আল্লাহ ও তাঁর শরীয়াহর অনুগামী করবো।
.
গণতন্ত্রীরা শরীয়াহকে তাদের খেয়ালখুশি এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অনুগামী বানাতে চাচ্ছে।
.
অর্থাৎ তাদের সমস্যা শুধু এটা না যে তারা ভুল করছে। মূল সমস্যা হল তারা তাদের ভুলকে বৈধতা দিতে গিয়ে দ্বীনকে রিইন্টারপ্রিট বা পুনঃব্যাখ্যা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজেদের খেয়ালখুশির কারণে তারা দ্বীন বিকৃত করছে।
লেখক : দাঈ ও অ্যাক্টিভিস্ট




