সাঈদ আহমাদ খান নদভী
তাকফির বা কাউকে কাফের সাব্যস্ত করা খুবই গুরুতর ও স্পর্শকাতর বিষয়। এটি এমন এক বিধান, যার সাথে মানুষের রক্ত, সম্মান ও সম্পদ জড়িত। তাই শরিয়ত এক্ষেত্রে কঠিন শর্তারোপ ও সুদৃঢ় মূলনীতি নির্ধারণ করেছে। এ বিষয়ে যারা গাফেল, তারা চূড়ান্ত বিভ্রান্তিতে পতিত হয়। কখনও গুলু (অত্যুক্তি), আবার কখনও ইফরাত (বাড়াবাড়ি)-এর শিকার হয়। তাই আমরা এখানে তাকফিরের ক্ষেত্রে শরিয়ত ও সালাফদের মানহাজভিত্তিক মূলনীতিসমূহ দলিলসহ তুলে ধরবো ইনশা আল্লাহ।
মূলনীতি ১:
أنَّ الحُكمَ بالكُفرِ لا يَكونُ إلَّا بِدَليلٍ شَرعِيٍّ مِنَ الكِتابِ أوِ السُّنَّةِ أوِ الإِجماعِ، لا بالتَّقليدِ، ولا بالعاطِفَةِ، ولا بالشُّبُهاتِ السِّياسِيَّةِ.
অর্থাৎ শরিয়তের কোনো বিষয়ে তাকফিরের ফয়সালা কেবল শরিয়তের দলিলের উপর ভিত্তি করে হতে হবে, অনুভূতি, অনুমান বা রাজনীতির ভিত্তিতে নয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَـٰفِرُونَ
[সুরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৪]
শাইখ আবু আবদুল্লাহ আল-মুহাজির (রহ.) বলেন:
أما من استبدل الشريعة بالقانون الوضعي فقد بدل الدين، ورضي بالكفر، فهو كافر بالإجماع.
“যে ব্যক্তি শরিআর বদলে মানুষের আইনের দ্বারা দ্বীনকে পরিবর্তন করেছে, এবং কুফরকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছে, সে সর্বসম্মতভাবে কাফের।”
[ফিকহুল জিহাদ, ২/৭৪৪]
সুতরাং, কাউকে তাকফির করতে হলেও আল্লাহর বিধান মুতাবেকই করতে হবে। তাহলেই তা শরিয়তসম্মত হবে।
মূলনীতি ২:
التَّفْرِيقُ بَيْنَ الْكُفْرِ الْأَكْبَرِ وَالْأَصْغَر
অর্থাৎ বড় কুফর (كفر أكبر) এবং ছোট কুফর (كفر أصغر)-এর মধ্যে পার্থক্য করতে হবে।
সব কুফর সমান নয়। কুফরের কিছু শাখা আছে, যেগুলো ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। আর কিছু আছে, যেগুলো ইসলাম থেকে বের করে না দিলেও মারাত্মক গুনাহ হিসেবে গণ্য হয়।
রাসুল (সা.) বলেন,
مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর নামে কসম করল, সে কুফরি করল বা শিরক করল।”
[তিরমিযি, হা/১৫৩৫]
ইমাম ইবনু আব্দিল বার বলেন:
الكفر في هذا الحديث ليس بالكفر المخرج من الملة، بل هو كفر أصغر.
এই হাদিসে কুফর দ্বারা এমন কুফর উদ্দেশ্য নয় যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। বরং এখানে কুফর দ্বারা কুফরে আসগর উদ্দেশ্য।
[আত-তামহিদ, ১৪/৩৬৬]
মূলনীতি ৩:
أن يكون الكفر ثابتًا بدليلٍ صريحٍ لا يحتمل التأويلَ
অর্থাৎ যে কুফরের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন এবং বিশুদ্ধ প্রমাণে প্রমাণিত হতে হবে।
দলিলটি হতে হবে স্পষ্ট ও মীমাংসিত, যাতে কোনো ধোঁকা, দুর্বোধ্যতা কিংবা ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ না থাকে।
রাসুল (সা.) বলেন,
إذا قال الرجل لأخيه يا كافر فقد باء بها أحدهما
[বুখারি, হা/৫৭৫৩, মুসলিম, হা/৬০]
অর্থাৎ, কেউ কাউকে কাফের বললে -যদি সে সত্যিই কাফির না হয়- তাহলে এই অপবাদ তার নিজের উপর ফিরে আসবে। এটি ইঙ্গিত করে, তাকফির এমন কিছু নয় যা অনুমান বা দুর্বল ভিত্তির উপর করা যায়।
মূলনীতি ৪:
لا يُكَفَّرُ المعيَّن حتى تُزالَ موانعُ التكفيرِ
অর্থাৎ, তাকফির করার আগে তাকফিরের প্রতিবন্ধকসমূহ অপসারণ করতে হবে। তাকফির করার আগে দেখতে হবে, উক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তাকফিরের হুকুম প্রয়োগের জন্য বাধা বা প্রতিবন্ধক কিছু আছে কিনা, যেমন: জাহালাত (মূর্খতা, ভুল তাফসির, ইকরাহ (বাধ্য হওয়া), তাবীল (ব্যাখ্যার সুযোগ), ইত্যাদি।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّىٰ نَبْعَثَ رَسُولًا
“আর আমি কোনো জাতিকে শাস্তি দিই না যতক্ষণ না তাদের নিকট একজন রাসুল পাঠানো হয়।”
[সুরা আল-ইসরা, আয়াত: ১৫]
ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন,
فَإِنَّ التَّكْفِيرَ لَهُ شُرُوطٌ وَمَوَانِعُ، قَدْ تَنْتَفِي فِي حَقِّ الْمُعَيَّنِ
“নিশ্চয়ই কাউকে তাকফির করার জন্য কিছু শর্ত এবং কিছু প্রতিবন্ধক রয়েছে, আর এই শর্ত ও বাধাগুলো কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকতে পারে (অর্থাৎ তার উপর প্রযোজ্য নাও হতে পারে)।”
[মাজমুউল ফাতাওয়া, ৩/২২৯]
মূলনীতি ৫:
اتباع منهج السلف في باب التكفير
অর্থাৎ, তাকফিরের ক্ষেত্রে সালাফের পথ অনুসরণ করতে হবে।
সাহাবা, তাবেঈন ও ইমামগণ যেভাবে সাবধানতার সাথে তাকফির করেছেন, তাকফিরের ক্ষেত্রে সেই পথই অনুসরণ করতে হবে।
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহ.) বলেন,
ومن قال بقول الخوارج فلا تُكفِّروه حتى تقوم عليه الحُجَّةُ.
“যে ব্যক্তি খারেজিদের মত কথা বলে, তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত কাফের বলো না যতক্ষণ না তার কাছে পরিষ্কারভাবে প্রমাণ তুলে ধরা হয় অর্থাৎ হুজ্জাহ কায়েম করা হয়।”
[আস-সুন্নাতু লিল-খাল্লাল, ৯৭৮]
মূলনীতি ৬:
ليس كل من وقع في الكفر وقع الكفر عليه
ব্যক্তির কুফরি কাজ করার মানেই কুফরি অবস্থানে পৌঁছানো নয়, যতক্ষণ না সমস্ত শর্ত পূরণ ও প্রতিবন্ধক দূর হয়।
তাকফিরের হুকুম আরোপের জন্য শুধু কুফরি কাজ করলেই যথেষ্ট নয়। বরং এর জন্য শর্ত পূরণ ও প্রতিবন্ধক দূরীকরণ আবশ্যক।
রাসুল (সা.) বলেন,
اللهم اغفر لقومي فإنهم لا يعلمون
“হে আল্লাহ! আমার কওমকে ক্ষমা করে দিন, তারা জানে না।”
[বুখারি, হা/৪৮২৪, মুসলিম, হা/১৭৯২]
ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন,
وأما الكفر فكما أن الإيمان له أصل وشعب، فكذلك الكفر له أصل وشعب
“ঈমানের যেমন একটি মূল ভিত্তি রয়েছে এবং এর বহু শাখা-প্রশাখা রয়েছে, ঠিক তেমনি কুফরেরও একটি মূল ভিত্তি রয়েছে এবং তারও অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে।”
[মাজমুউল ফাতাওয়া, ৭/৬১৫]
মূলনীতি ৭:
التكفيرُ حكمٌ شرعيٌّ، فلا يَجوزُ إلا لِأهلِ العِلمِ والبصيرةِ
তাকফির একটি বিচার বা হুকুম, তাই তা শুধুমাত্র আহলে ইলম ও কাজিগণ আরোপ করতে পারে। এটা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। বরং শরিআহ ও ইলমের গভীরতা সম্পন্ন মহান ব্যক্তিদের কাজ।
শাইখ ইবনু বায (রহ.) বলেন,
التكفير حكم شرعي مرده إلى الله ورسوله، فلا يكفي فيه مجرد قول أو فعل وقع من شخص حتى تقوم عليه الحجة وتزال عنه الشبهة.
“তাকফির করা একটি শরঈ হুকুম, এর সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়। তাই কাউকে কাফের বলার জন্য শুধু তার কোনো কথা বা কাজ যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না তার উপর দলিল (হুজ্জাহ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার সন্দেহ দূর করা হয়।”
[মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনু বায, ৯/৩১১]
সম্মানিত পাঠক! উপরের সাতটি মূলনীতি অনুসরণ করা ছাড়া তাকফির করা মারাত্মক গোমরাহি ও ফেৎনার কারণ হতে পারে। অতএব, তাকফির একটি নাজুক দায়িত্বপূর্ণ শরঈ বিধান যা কেবল শরিয়তের সুস্পষ্ট দলিল ও ইলম অনুযায়ী হতেই পারে। আবেগ, দলান্ধতা বা অল্প ইলমের ভিত্তিতে এ পথে পা বাড়ানো নাজায়েয।
তাকফির করার পূর্বশর্তসমূহ:
তাকফির (কারো উপর কুফরের হুকুম আরোপ) করার আগে শরিআকর্তৃক নির্ধারিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূর্ণ হওয়া আবশ্যক। এ শর্তগুলো অনুপস্থিত থাকলে, সেই ব্যক্তিকে শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘কাফের’ বলার অনুমতি নেই, যদিও তার কাজটি কুফরি বা গর্হিত হতে পারে।
শাইখ আতিয়্যাতুল্লাহ আল-লিব্বি (রহ.) বলেন:
ليس كل من وقع في الكفر وقع الكفر عليه، بل لا بد من توفر الشروط وانتفاء الموانع.
“যে কেউ কোনো কুফরি কাজে লিপ্ত হয়েছে বলে সে যে নিশ্চিত কাফের, বিষয়টা এমন নয়, বরং তাকফির করার জন্য শর্ত পূর্ণ হতে হবে এবং প্রতিবন্ধকতা না থাকতে হবে।”
[মানযূমাতুত তাওহীদ ওয়াল-জিহাদ, পৃ: ১৫]
নিচে কুরআন, সুন্নাহর আলোকে তাকফিরের শর্ত তুলে ধরা হলো:
১. العلم অর্থাৎ সঠিক জ্ঞান থাকা।
যাকে কাফের বলা হচ্ছে, তার মধ্যে প্রথম শর্ত হলো, তার পর্যন্ত সঠিক ইসলামি জ্ঞান পৌঁছানো, অর্থাৎ সে যদি জেনে বুঝে কুফরি কাজটি করেছে, তাহলে তাকে তাকফির করা যাবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولًا
“আমি কখনোই (কাউকে) শাস্তি দেই না, যতক্ষণ না একজন রাসুল পাঠানো হয়।”
[সুরা ইসরা, আয়াত: ১৫]
এই আয়াত প্রমাণ করে, কোনো ব্যক্তি ইসলামের মৌলিক দাওয়াত না পেলে, জ্ঞান না থাকলে, তাকফির বা শাস্তি প্রয়োগ হয় না।
ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন:
فإن الكفر عدم الإيمان، وليس كل من وقع في الكفر كان كافرا.
“কুফর মানে হলো ঈমান না থাকা; তবে প্রত্যেক ব্যক্তি যিনি কুফরের কোনো কাজে জড়ালেন, তিনি কাফের হয়ে যান না।”
[মাজমুউল ফাতাওয়া, ১২/৪৮৮]
২. القصد অর্থাৎ ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য থাকা।
তাকফির করার পূর্বশর্ত হলো, ব্যক্তির কাজটি ইচ্ছাকৃত হতে হবে। ভুলে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হলে তাকফির করা যায় না।
নবি কারিম (সা.) বলেন,
إن الله تجاوز لي عن أمتي الخطأ والنسيان وما استكرهوا عليه
“নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য ক্ষমা করেছেন ভুল, বিস্মৃতি এবং জোর-জবরদস্তিতে সংঘটিত কাজ।”
[ইবনু মাজাহ, হা/২০৪৫]
অতএব, কেউ যদি ভুল করে কুফরি কাজ করে বসে, তাহলে তাকফির করা যাবে না; যতক্ষণ না জানা যায় সে ইচ্ছাকৃত করেছে।
৩. الاختيار অর্থাৎ নিজের ইচ্ছায় কাজটি করা।
একজন ব্যক্তি যদি জোরপূর্বক বা প্রাণনাশের ভয়ে কুফর উচ্চারণ করে, তাহলে তাকফির করা হবে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالإِيمَانِ
“তবে যে ব্যক্তিকে জবরদস্তি করা হয়েছে এবং তার অন্তর ঈমানের উপর স্থির রয়েছে, সে ব্যতিক্রম।”
[সুরা নাহল, আয়াত: ১০৬]
এই আয়াতটি আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাযি.) সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল, যিনি প্রাণ বাঁচানোর জন্য মুখে কুফরের কথা বলেছিলেন, কিন্তু অন্তরে ঈমান অটুট ছিল। তাই রাসুল (সা.) তাকে তাকফির করেননি।
৪. إزالة الشبهات অর্থাৎ সন্দেহ দূর হওয়া।
যদি কেউ কোনো শরঈ অজুহাতে বা ভুল ফোতওয়ার কারণে কুফরিতে লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে তাকফির করা যাবে না, যতক্ষণ না তার সেই ভুল সংশোধন করা হয়।
ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.)
“وإن كان الخطأ في التأويل، فقد ثبت في الصحاح أن الذي قال: أنت عبدي وأنا ربك، أخطأ من شدة الفرح، لم يكفر.”
“সহিহ বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি বলেছিল: ‘তুমি আমার দাস আর আমি তোমার প্রভু’, সে আনন্দে ভুল করেছিল, তাই তাকফির করা হয়নি।”
[মাজমুউল ফাতাওয়া, ৭/২২৪]
সুতরাং, কেউ যদি ভুলবশত কুফরি কথা বলে ফেলে, তবে তাকে সতর্ক না করা পর্যন্ত তাকফির করা যাবে না।
সম্মানিত পাঠক! তাকফির অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। যার মধ্যে এই চারটি মূল শর্ত (জ্ঞান, ইচ্ছা, স্বাধীনতা ও সংশয় দূরীকরণ) পাওয়া না যায়, তাকে তাকফির করা জায়েয নয়। শর্ত না মেনে তাকফির করলে সেটা তাকফিরে বিদআহ বা তাকফিরে খারেজিয়্যাহ বলে বিবেচিত হবে।
রাসুল (সা.) হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন:
إذا قال الرجل لأخيه: يا كافر، فقد باء بها أحدهما
“যদি কেউ তার ভাইকে ‘হে কাফির’ বলে, তবে এ কথা দু’জনের একজনের ওপর প্রযোজ্য হয়ে যায়।”
[সহিহ বুখারি, হা/৬১০৪]
তাকফিরের প্রতিবন্ধকতা:
এখানে আমরা আলোচনা করবো সেই প্রতিবন্ধকসমূহ নিয়ে, যেগুলো বিদ্যমান থাকলে তাকফির করা জায়েয হবে না:
১. الجهل অজ্ঞতা:
অর্থাৎ যে ব্যক্তি দ্বীনের মূল ও অপরিহার্য বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ, তার কুফরি কথা বা কাজ তখনই তাকফিরযোগ্য হবে, যখন সে জেনেবুঝে করেছে বলে সাব্যস্ত হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
“আমরা কোন জাতিকে শাস্তি দেই না যতক্ষণ না তাদের কাছে একজন রাসুল পাঠানো হয়।”
[সুরা আল-ইসরা, আয়াত: ১৫]
তিনি আরও বলেন,
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ
“রাসুলগণ এসেছেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হয়ে, যাতে রাসুলদের পর মানুষের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন দলিল না থাকে।”
[সুরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৫]
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহ.) বলেন:
من ثبت إسلامه بيقين، لم يزل عنه ذلك بالشك، بل لا يزول إلا بعد إقامة الحجة وإزالة الشبهة.
“যার ইসলাম নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, তাকে সন্দেহের ভিত্তিতে কাফির বলা যাবে না; বরং তাকে কাফির বলার আগে হুজ্জাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তার সংশয় দূর করতে হবে।”
[মাজমুউল ফাতাওয়া, ১২/৪৬৬]
তবে, এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, শিরকে আকবারের ক্ষেত্রে অজ্ঞতা তাকফিরের জন্যে কোনো ওজর বলে গণ্য হবে না।
২. التأويل তাবীল বা ভুল ব্যাখ্যা করা।
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি এমন একটি কথাবার্তা বা কাজ করল, যা প্রকৃত অর্থে কুফরি, কিন্তু সে তা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে বৈধ মনে করেছিল।
ইমাম ইবনু কুদামাহ (রহ.) বলেন:
ومن اعتقد غير ما ظهر له، وغلب على ظنه أنه هو الحق بتأويل سائغ لم يكفر.
“যে ব্যক্তি বাহ্যিক কুফরি কথার ভিন্ন অর্থ নিয়েছে এবং তার ধারণা হয়েছে সেটাই সত্য, বৈধ ব্যাখ্যার কারণে, তাকে কাফের বলা যাবে না।”
[আল-মুগনি]
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহ.) বলেন:
إن التكفير لا يكون لمن تأول تأويلاً سائغاً، وإن كان مخطئاً.
“যে ব্যক্তি বৈধ তাওয়িল করেছে, তাকে তাকফির করা যায় না, এমনকি যদি সে ভুলও করে থাকে।”
[দারউ তাআরুযিল আকলি ওয়ান নাকল, ২/৯৬]
৩. الإكراه বাধ্য করা বা জবরদস্তি করা।
অর্থাৎ যদি কোনো মুসলমান প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়ে এমন কিছু বলে বা করে যা কুফরি, তবে সেটা তাকফিরের ভিত্তি হতে পারে না যদি সে অন্তরে ঈমানের উপর অটল থাকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالإِيمَانِ
“তবে যে ব্যক্তি বাধ্য হয়েছে, অথচ তার অন্তর ঈমানের উপর অটল ছিল, তার কোনো দায় নেই।”
[সুরা আন-নাহল, আয়াত: ১০৬]
উদাহরণস্বরূপ:
আম্মার ইবন ইয়াসির (রা.) কে মুশরিকরা কষ্ট দিয়ে কুফর বলাতে বাধ্য করেছিল। তিনি তা বললেও অন্তরে ঈমান বজায় রেখেছিলেন। নবি ﷺ তাঁকে কাফের বলেননি; বরং তার ঈমানের প্রশংসা করেছিলেন।
[সিরাতে ইবনে হিশাম, হাদিসের মূল সনদ: সহিহ মুসলিম, ৫২৭৭]
৪. الخطأ والنسيان ভুল বা ভুলে যাওয়া।
অর্থাৎ যদি কেউ ভুলবশত কুফরি কথা বলে ফেলে বা ভুলে যায় যে তা কুফর, তাহলে তাকফির করা যাবে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
رَبَّنَا لا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
“হে আমাদের রব! যদি আমরা ভুলে যাই বা ভুল করি, তবে আমাদেরকে পাকড়াও করো না।”
[সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৬]
নবি কারিম (সা.) বলেন,
إن الله تجاوز عن أمتي الخطأ والنسيان وما استكرهوا عليه.
“নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুল, ভুলে যাওয়া এবং যা তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সব মাফ করে দিয়েছেন।”
[সুনান ইবন মাজাহ, হা/২০৪৩]
মোটকথা, কেউ প্রকাশ্যে কুফরি কথা বললে বা কাজ করলে তৎক্ষণাৎ তাকফির করার আগে ইসলামি শরিআর নির্ধারিত শর্তসমূহ পূরণ হয়েছে কি না এবং উপরোক্ত প্রতিবন্ধকসমূহ বিদ্যমান কি না, তা যাচাই করা অত্যাবশ্যক। ভুলভাবে তাকফির করা শুধু একটি গুনাহ নয়, বরং তা একটি মারাত্মক ফিতনা ও ধ্বংসের পথ।




