ইসরাইলের অর্থনীতিতে গাজা যুদ্ধের প্রভাব

ইবনুল কালাম

গাজা যুদ্ধের তৃতীয় মাস চলছে। গত ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা গাজাকে গুঁড়িয়ে দেবেন। কিন্তু ইসরাইল যতটা ধারণা করেছিল, গাজা যুদ্ধ তার চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘ হতে চলেছে। সেজন্য কোনো কোনো ইসরাইলি কর্মকর্তা হতাশ হয়ে বলেই ফেলেছেন, এই যুদ্ধের শেষ কোথায়, তা এখনো অস্পষ্ট। তবে সময় যত অগ্রসর হচ্ছে, ইসরাইল ততই বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ছে।
সম্ভবত গাজা যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে ইসরাইলের অর্থনীতিকে। এত বড় ধাক্কা হয়তো তাদের অন্য কোনো খাতে মোকাবেলা করতে হয়নি। কারণ, এই যুদ্ধের ফলে একদিকে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যয় কল্পনাতীত বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে অর্থনীতির নানা অংশও স্থবির হয়ে আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে এসেছে। ফলে এই অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিতে তারা রীতিমত হিমশিম খেতে শুরু করেছে।
দেশটির উল্লেখযোগ্য আয়ের উৎস পর্যটন শিল্প। ইতোমধ্যে পর্যটন শিল্প বড় ধরণের ধ্বসের মুখোমুখি হয়েছে। গাজা যুদ্ধের প্রভাবে দেশে জান-মালের নিরাপত্তা নেই। তাই পর্যটকদেরও আর আগের মতো ভিড় নেই। জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম হয়। যিশু খ্রিষ্টের জন্মভূমি হওয়ায় খ্রিষ্টীয় ছুটির সময় অনেকেই জেরুজালেম ভ্রমণে আসতো। এতে প্রতিদিন অর্ধ-লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম ঘটতো। তারা স্থানীয় নানা আবাসিক হোটেলে অবস্থানও করতো। এতে ইসরাইলের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিনেও পর্যটকদের আগমন আগের মতো ঘটেনি। বরং পরিমাণ ২০ থেকে ২২ হাজারে সীমাবদ্ধ থেকেছে।
এছাড়া নানা আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার সকল ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়াও পর্যটন শিল্পের ধ্বসকে ত্বরান্বিত করেছে। একদিকে তারা নিজেদের সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে, অপরদিকে যুদ্ধের ঝুঁকিবিষয়ক আন্তর্জাতিক বীমার যে রীতি ছিল, সেটিও বাতিল করে দিয়েছে। ফলে চতুর্মুখী চাপে পড়েছে ইসরাইল সরকার।
ইসরাইলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য খাত হলো প্রযুক্তি শিল্প। তাদের মোট রফতানির ৫০ ভাগই আসে এই খাত থেকে। এই খাতেও পড়েছে গাজা যুদ্ধের ব্যাপক প্রভাব। গাজা যুদ্ধ দেশের ইতিবাচক পরিবেশ বিনষ্ট করেছে। এতে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর ব্যবসায়িক বিকাশ প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে। ইসরাইলে বর্তমানে মাইক্রোসফট, আইবিএম, ইনটেল, গুগলসহ প্রায় ৫০০ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে। তারা এমন অস্থিতিশীল পরিবেশে বিনিয়োগ করবে কিনা, সেটি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রযুক্তি খাতে মূলত ধাক্কাটা লেগেছে গত বছর। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকার বিচার বিভাগের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিতর্কিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এতে প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা আশাহত হয়। তাদের অনেকে অর্থও সরিয়ে নেয়। ফলে তখনই বৈদেশিক বিনিয়োগ ৬০ শতাংশ কমে যায়। গাজা যুদ্ধের প্রভাবে তাই এই খাতটি বড় নাকাল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়।
প্রযুক্তি খাতে আরো বড় ধাক্কা আসে ভিন্ন প্রক্রিয়া থেকে। গাজা যুদ্ধের ধাক্কা সামাল দিতে ইসরাইল রিজার্ভ বাহিনী থেকে সৈন্য নিয়েছে। তারা রিজার্ভ বাহিনীর অন্তত ৩ লাখ ৬০ হাজার সদস্য নতুন করে সেনাবাহিনীতে যুক্ত করেছে। এই রিজার্ভ বাহিনীর বড় একটি অংশ নানা প্রযুক্তি শিল্পের উদ্যোক্তা ছিলেন। তাদের বিয়োগে এই খাতটিতে বড় ধরণের ছন্দপতন ঘটেছে। ফলে প্রযুক্তি খাতের ধাক্কাটা অর্থনীতিতে বড় ধরণের প্রভাব ফেলেছে।
ইসরাইলের বড় আরেক আয়েরটি খাত হলো সমরাস্ত্র রফতানি শিল্প। বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তি করে সমরাস্ত্র রফতানি করতো দেশটি। এতে তাদের বড় ধরণের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটতো। কিন্তু গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে সমরাস্ত্রের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে নিজের দেশেই। এতে দেশটি একদিকে অন্য দেশকে রফতানি করে আয় বাড়াতে পারছে না। অপরদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে হামাসের হামলায় ভারি ভারি সমরাস্ত্র হারিয়ে দেশটির পুরো বিনিয়োগটাই ভেস্তে যাচ্ছে। ফলে সমরাস্ত্র রফতানি শিল্পেও দেশটি বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে।
গাজা যুদ্ধ সামাল দিতে গ্যাস প্রকল্পের লোকজনকেও সেনাবাহিনীতে যুক্ত করতে হয়েছে। এতে ইসরাইলের বড় একটি অফশোর প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। অথচ এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে তাদের আয়ের সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। তা থেকে তারা ইউরোপসহ অন্যান্য দেশেও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে ব্যাপক লাভবান হওয়ার কথা ছিল।
ইসরাইলে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার ফিলিস্তিনি কাজ করতো। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইসরাইল সরকার তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠায়। একইসাথে ঘোষণা দেয় যে তারা আর ফিলিস্তিনিদের কাজের সুযোগ দেবে না। তবে এই শূন্যতা পূরণে ভারত থেকে শ্রমিক আমদানি করা হবে। এর অর্থ হলো, ইসরাইলকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে প্রবাসীদের কর্মসংস্থান করতে হবে। তাদের বাসস্থান ও বিমানভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এটাও তাদের উপর বড় ধরণের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
এদিকে, যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ইসরাইলি মুদ্রা শেকেলের দর পতন শুরু হয়েছে। মুদ্রার মান ঠিক রাখতে মরিয়ে হয়ে উড়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটাও তাদের অর্থনীতিতে বড় ধরণের চাপ সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া ইসরাইলের অর্থনীতিকে নাজেহাল করে তুলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা ব্যয়। যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরাইলের অর্থ মন্ত্রণালয় ধারণা করেছিল, ৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই এই যুদ্ধের ব্যয় ভার বহন করা সম্ভব। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, তাদের আশঙ্কাও তত বেড়েছে। এখন তারা ধারণা করছে, এই খরচ ৪০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্তও গড়াতে পারে। যদি এই ধারণাই ঠিক হয়, তবে এটি তাদের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। সময়ের আগেই তাই তারা নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
আর্থিক ব্যয় কমানোর জন্য ইতোমধ্যে দেশটি নানা সেক্টরেই কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানী তেল আবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের শত শত কর্মীকে ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারা অন্তত ৬০০ কর্মচারীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সময় তাদেরকে কোনো বেতন-ভাতাও দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আরো হাজার খানিক কর্মচারীর আর্থিক বরাদ্দ ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। আরো এক হাজার কর্মচারিকে ইসরাইলের রিজার্ভ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে বিমানবন্দরের কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে আসবে। সাধারণত গুরিয়ন বিমানবন্দরে ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৬০০ কর্মচারি কাজ করে। এ সিদ্ধান্তের পর ওই সংখ্যা তিন হাজারেরও নিচে নেমে আসবে।
এদিকে, পর্যটন শিল্পকে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য ইসরাইল সরকার আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার সাথে আলোচনা শুরু করেছে। নানাভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য আশান্বিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। স্থানীয় এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়। কারো ক্ষতি হলে ওই বরাদ্দ থেকে তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ফলে তারা সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাতে রাজি হয়েছে।
অপরদিকে, জার্মানভিত্তিক এয়ারলাইন্স গ্রুপ লুফথানসা আংশিকভাবে তাদের ফ্লাইটগুলোকে চালু করতে সম্মত করেছে। ইসরাইল সরকার আশা করছে, তাদের ঘোষিত যুদ্ধ ঝুঁকিবিষয়ক বীমার অবদানে আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের ফ্লাইট চালু করবে। ফলে পর্যটন শিল্পে প্রাণ ফিরে পেতে পারে।
তবে বাস্তবতা হলো, ইসরাইলের অর্থনৈতিক ক্ষতি যা হওয়ার তা ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। তবে এখন যদি তারা অর্থনৈতিক বিকাশ পুনরুদ্ধার করতে চায়, তবে তাদেরকে অবশ্যই দেশে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা উভয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আর সেজন্য তাদেরকে হাঁটতে হবে যুদ্ধ বিরতির পথে। অবশ্য তারা ইতোমধ্যে ওই সুযোগও পেয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে যখন সরকার মরিয়া, তখন সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকাশ পায় বড় ধরণের ভুল। তারা গাজায় হামাসের হাতে বন্দী থাকা নিজেদের তিন নাগরিককে ‘ভুল করে’ গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এটি যদিও তাদের বড় ধরণের ভুল ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটাই তাদের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে। ইসরাইলি সেনাদের এই ভুলের ফলে ইসরাইলি জনগণের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরতির আওয়াজ ওঠে। তাই সরকার নতুন করে যুদ্ধ বিরতির পথে অগ্রসর হয়। অর্থনৈতিক পতন ঠেকাতে যুদ্ধ বিরতির পথে হাঁটা যখন আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন নতুন এই সুযোগ তাদের অর্থনৈতিক অবক্ষয়কে ঢেকে দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। ফলে ইসরাইল ফের ‘স্বাচ্ছন্দ্যে’ আলোচনার টেবিলে বসে।
পরে যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময় নিয়ে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমানের সাথে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়া বৈঠক করে। এরপর কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। একটি সমন্বিত ও টেকসই চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে যুদ্ধ অবসানের প্রত্যাশা করছে কাতার।’

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংবাবিক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top